ফিচার

‘ধর্ষকের পক্ষে অনেকটাই নীরব সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে’

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ২৬ নভেম্বর, ২০২১

চার বছর আগে অভিযোগ করা রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ মামলায় ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল—৭ এর বিচারে মেডিকেল রিপোর্ট না পাওয়ায় আদালত গত ১১ নভেম্বর মামলাটি প্রত্যাহার করেছেন। এরই সাথে ৭২ ঘণ্টা পর ধর্ষণের আলামত পাওয়া না গেলে, পুলিশ যেন ৭২ ঘণ্টা পর কোনো ধর্ষণের মামলা না নেন সে নির্দেশনাও প্রদান করেছেন। আদালতের এমন নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন—রুকাইয়া মিজান মিমি


আইন প্রণয়নে সামগ্রিক মূল্যায়ন প্রয়োজন

ঘরে—বাইরে ধর্ষণের ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়ে যাচ্ছে। ছোট্ট শিশুটি থেকে বৃদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না। দেশে কঠোর আইন থাকা সত্ত্বেও গতানুগতিক ধারায় দেখা যায় ফ্রিজ রেসপন্স, পারিবারিক বাঁধা, সমাজে কলঙ্কিত হওয়ার ভয়, ভবিষ্যৎ চিন্তা এবং প্রশাসনের গতিময়তার অভাবসহ নানা সংকটের কারণে ভুক্তভোগী ঘটনার পরবর্তী সময়ে অতিদ্রুত আইনের শরণাপন্ন হতে পারে না। এরই মাঝে আদালতের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে মেডিকেল রিপোর্ট দেখাতে না পারায় মামলা প্রত্যাহারের ঘটনাটি ধর্ষকের পক্ষে অনেকটাই নীরব সমর্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে আশঙ্কা করা যায়। কেননা, নির্দিষ্ট সময়টিতে ধর্ষক চক্র ধর্ষিত মেয়েটিকে আটক করে রাখতে পারে। এতে করে সে পুরোপুরি বিচারব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হবে। অন্যদিকে সাইবার বুলিংয়ের প্রভাব, জীবনের ঝুঁকি, তাৎক্ষণিক ঘটনাকে প্রকাশ করতে না পারার প্রবণতায় স্বাভাবিকভাবেই মামলায় কালবিলম্ব হতে পারে। তাই শুধু সময় বেঁধে দিয়ে একমূখী চিন্তা না করে সামগ্রিকভাবে বিষয়টিকে মূল্যায়ন করা দরকার।
সেইসাথে এমন অনাকাঙি্ক্ষত ঘটনা যেন সংঘটিত না হয় সেজন্য ওয়ার্কশপের পরিধি আরো বাড়াতে হবে। সেসব ওয়ার্কশপে কোন প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা নিয়ে পূর্ব ধারণা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। ছেলেবন্ধু নির্বাচনের ক্ষেত্রে চরিত্র নিরূপণের প্রক্রিয়া আলোচনা করা দরকার। সে বাজে কোন ইঙ্গিত করছে কিনা; জনশূন্য কোন স্থানে নিয়ে যাচ্ছে কিনা; অরক্ষিত কোনো খাবার খাওয়াতে চাচ্ছে কিনা এমন সন্দেহমূলক আচরণ চোখে পড়লেই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াটি কেমন হবে তা গভীরভাবে তরুণসমাজকে বোঝাতে হবে। প্রয়োজনে করণীয় সম্পর্কে ভিডিও কনটেন্ট প্রদর্শন করে সমাজকে সজাগ করতে হবে। সেই সাথে ভুক্তভোগীর মানসিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি তার প্রতি যেন কোনো বিদ্বেষপূর্ণ আচরণ না আসে তা সমাজ ও পরিবারকে নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি একদিকে যেমন আইনের সরলতা প্রয়োজন অন্যদিকে তেমনি ঘটনা যেন সংগঠন না হয় সেদিকেও নজর রাখা জরুরি।

ড. ফারহানা জামান, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।


আইন প্রণয়নে প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় রাখা জরুরি

ধর্ষণের পর ফিজিক্যাল আলামত একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাওয়া যায়। তবে যদি ৭২ ঘন্টার পরেও আলামত পাওয়ার ন্যূনতম সম্ভাবনা থাকে তাহলে আদালতের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে আরো বিচক্ষণতার প্রয়োজন। এছাড়া মেডিকেল রিপোর্টের বাইরে অন্যান্য উপায়েও ঘটনাকে তদন্ত করা যায়, মামলার রায় প্রদানে সেদিকগুলোকে সামনে আনা প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সিসিটিভি ফুটেজ এক্ষেত্রে আস্থাভাজন এক মাধ্যম। এর ব্যবহারে ভিডিও ক্লীপে ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করে অভিযুক্তকে শাস্তি প্রদান করা যায়। যদিও এ রায় প্রদানের পর বিচারককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে তবুও মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় এর প্রভাবকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।
এছাড়াও ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ঘটে থাকে, তাই মামলা পর্যালোচনায় সেসব প্রেক্ষাপটকে বিশ্লেষণ করা জরুরি। শুধু যে নারীরাই ধর্ষণের শিকার হয় তা নয়। কিছু কিছু সময় পুরুষরাও ধর্ষিত হতে পারে। বিশেষ করে অধিকাংশ সময়ই ছোট্ট শিশুরা ধর্ষণের কবলে পরলে তারা অপরাধের মাত্রা ও ধরণ বুঝতে পারে না। উপরন্তু এ সময় তাদের মাঝে অনেক সংকোচ ও দ্বিধা ভিড় করায় বিষয়টি দ্রুত বড়দেরকেও জানাতে পারে না। সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক আইনের আশ্রয় নেয়া সম্ভবপর হবে না।
আর এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনার মোকাবিলায় সমাজকে প্রস্তুত করতে হবে। এজন্য সবার মাঝে মানুষ হবার শিক্ষার বিস্তার ঘটানো জরুরি। বিশেষ করে সামাজিক মূল্যবোধের জাগরণ, নারী পুরুষের সহমর্মিতাবোধ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন আরো বাড়াতে হবে। সেই সাথে মনুষ্যত্বের গুণাবলীর বিকাশ স্কুল পর্যায় থেকেই যদি ছেলে মেয়েদের মাঝে নিশ্চিত করা যায় তবে এমন অপরাধের মাত্রা অনেক কমে যাবে।

ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ, অধ্যাপক, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়।


আইনকে ভুক্তভোগীর অনুকূলে রাখতে হবে

৭২ ঘণ্টার মাঝে ধর্ষণ মামলার মেডিকেল রিপোর্ট দাখিল করতে না পারায় মামলা প্রত্যাহার ও পরবর্তীতে সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে গেলে আদালতের মামলা গ্রহণ না করার নির্দেশনাটি বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। এদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও গঠন ব্যবস্থা পুরুষতান্ত্রিক হওয়ায় ধর্ষণ মামলায় অপরাধীর থেকে ভুক্তভোগীকেই বেশি সামনে আনা হয়। তাই লোকলজ্জার ভয়, নিরাপত্তা, পারিবারিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ হয়রানির কথা ভেবে ভুক্তভোগী সহজেই মামলা করতে চায় না। ফলে অনেক সময় বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনাই সমাজ ও রাষ্ট্রের অগোচরে থেকে যায়। ইতোপূর্বে ধর্ষণের ঘটনা এবং এ সংক্রান্ত মুভিগুলোতে বিষয়টি পর্যবেক্ষিত হয়েছে।
এছাড়া শুধুমাত্র শহরকেন্দ্রিক চিন্তা না করে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথাও ভাবা দরকার। সেখানে একজন ভুক্তভোগী ও তার পরিবার চাইলেও সহজেই মামলা করতে পারে না। পারিপার্শ্বিক চাপ, শত্রুপক্ষের হুমকি নিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে থানায় গিয়ে মামলা করাটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ, নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে তা সম্ভব নাও হতে পারে। তাই সবদিক বিবেচনা করে আইন প্রয়োগ করা প্রয়োজন।
আমরা সহযোগিতার মাধ্যমে সমাজে বসবাস করতে চাই। সেখানে আইন অপরাধীকে দমন করে ভুক্তভোগীর জন্য সম্মান নিরাপত্তা ও শান্তি সৃষ্টি করবে এবং আইনের আধুনিকায়ন তাকে সাহায্য করবে।

অধ্যাপক ড. রাশেদা ইরশাদ নাসির, চেয়ারম্যান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads