দীর্ঘ এগারো মাস সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করে গত সপ্তাহে একেবারে নিঃস্ব হাতে দেশে ফেরেন শাহিদা বেগম। স্বামীর সঙ্গে নিজেও ধরতে চেয়েছিলেন সংসারের হাল। তাই স্বামীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাশের বাড়ির এক মহিলার মাধ্যমে সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। শেষপর্যন্ত সংসারের আর্থিক সচ্ছলতার কথা চিন্তা করে রাজি হন তার স্বামীও। কিন্তু যে সচ্ছলতার আশায় দেশে স্বামী-সন্তান রেখে পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে, সে সচ্ছলতার মুখ তার আর দেখা হয়নি। শাহিদার মুখেই শোনা গেল তার স্বপ্নভঙ্গের কথা। সৌদিতে এজেন্সির অফিস থেকে বিভিন্ন বাসায় কাজে পাঠানো হতো তাদের। চুক্তি অনুযায়ী কাজ শেষে বাসার মালিকরা সেই এজেন্সির অফিসের লোকের কাছে তাদের বেতনের টাকা দিয়ে যেত। এভাবেই এগারো মাস কাজ করে প্রাপ্ত বেতনের টাকা সৌদির সেই এজেন্সির লোকজন কখনই তাদের হাতে বুঝিয়ে দিত না। যেসব বাসায় কাজ করতেন সেখানকার মালিকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার তো হতেই হতো, সেই সঙ্গে এজেন্সির লোকজনও মারধর এবং গালিগালাজ করত কাজে যেতে না চাইলে। শাহিদা বলেন, ‘একবার প্রথম মালিকের বাসায় চার মাস কাজ কইরা আইসা কইলাম আমি আর কাজ করমু না, আমারে বাংলাদেশ পাঠায়া দেন। এর লাইগ্যা আমারে মাইরা সাত দিন একটা ঘরে আটকায়া রাখল। পানি, খাওন কিছুই দিল না। জোর কইরা আরেক বাসায় কামে পাঠাইল।’ এভাবে এক বাসায় থাকতে থাকতেই কাজের জন্য রেডি করে রাখা হতো আরেক বাসা। যেতে না চাইলেই লোহার রড, তার, বেত দিয়ে চলত নির্যাতন। বাসায় কাজ করার সময়তো নির্যাতন চলতই। সারাদিন শেষে একটা রুটি আর পানি খেতে দেওয়া হতো। কোনো কোনো বাসায় ঘুমাতে দেওয়া হতো না। কাজ না থাকলেও না ঘুমিয়ে বসে থাকতে বলা হতো। এমন ঘুমহীন কাটিয়েছেন কত রাত তার হিসাব রাখেননি শাহিদাও।
এত রক্ত-ঘামের বিনিময়ে কখনো ভাগ্য ভালো হলে কোনো কোনো বাসার মালিক খুশি হয়ে হাতে কিছু টাকা দিত। তেমন প্রায় পাঁচ হাজার টাকাসহ বাড়িতে যোগাযোগ করার মোবাইল নম্বর শাহনাজ লুকিয়ে রেখেছিলেন বোরকার সেলাইয়ের মধ্যে। এজেন্সির লোকজন দেশে ফেরার আগে সেটিও ছিনিয়ে রেখে দেয়। দেশে ফিরে তার পারিশ্রমিকের টাকা দাবি করতে পারবে না- এমন শর্তে তাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়। শাহনাজ বলেন, ‘ওই দেশে আমার মতো আরো যারা আছে তারা কেউ ভালো নেই। যেইহানে কাজ করে সেইহানে মাইর তো খায়ই ইজ্জত সন্মানও খোয়ান লাগে। অনেক কষ্টে নিজেরে নিজে বাঁচায়া রাইখা কাজ করছি। তাই নিজের সন্মান নিয়া স্বামীর কাছে ফিরতে পারছি।’ নির্যাতনের শিকার শাহনাজ আরো বলেন, ‘আমি ভাবছিলাম দেশে যাইতে পারলে আমি সবাইরে বলমু সৌদি যেন কেউ না আসে। আপনারা সৌদিতে লোক পাঠানোটাই বন্ধ কইরা দেন। এখানে মানুষ একটুও ভালো থাকে না।’ শাহনাজ বেগম দেশে ফিরে দ্বারস্থ হয়েছেন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার। তিনি যেন তার এগারো মাসের প্রাপ্য পারিশ্রমিক ফিরে পান সে জন্য কাজ করছে সংস্থাটি। শাহনাজ এবং তার স্বামীর একটাই চাওয়া- এত অত্যাচার সহ্য করেও যে কয়টা টাকা রোজগার করেছিলেন সেই কষ্টার্জিত টাকাটা যেন তিনি ফিরে পান। তাহলে এত দিনের কষ্টভোগ কিছুটা হলেও কম হবে। শরীরে এখনো নির্যাতনের চিহ্ন বয়ে বেড়ানো শাহনাজ বার বার আকুতি জানিয়ে বলছেন, ‘আমার পরিশ্রমের টাকা অরা খাইতেছে, আপনারা আমার টাকাটা পাওনের ব্যবস্থা কইরা দেন।’