পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য ধর্মের প্রতি একটি দেশ, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও তার সর্বস্তরের জনগণ কীভাবে পাশে দাঁড়াতে পারে, তার প্রকৃষ্ট নমুনা দেখিয়ে দিল নিউজিল্যান্ড। মানবতা, সহনশীলতা, সহমর্মিতার দৃঢ় ও নবযুগের সূচনা করল নিউজিল্যান্ড। বিশ্বশান্তির জন্য নিউজিল্যান্ড একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘৃণা ছড়ানো কিংবা নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বসহ অন্যান্য দেশে বিক্ষোভ আর মিছিল হওয়ার কথা, সেখানে সে দেশের নেত্রীর জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ভালোবাসা, সহমর্মিতা, সহনশীলতার কাছে পুরো বিশ্ব মুগ্ধ। মুসলিম বিশ্বসহ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিক্ষোভ আর শোকের পরিবর্তে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডাকে নেতা হিসেবে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে! বিশ্বের যেখানে যে সংবাদপত্রের দিকেই চোখ রাখুন না কেন, সর্বত্রই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, জনগণ ও সংবাদমাধ্যমের জয়গান। নিউজিল্যান্ডে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের স্মরণে কিংবা মুসলমানদের নিরাপত্তা বিধানে যে কাজই করুক না কেন, সেই কাজের জন্য নিউজিল্যান্ডের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা অজান্তেই বৃদ্ধি পায়। যে কোনো হত্যাকাণ্ডের জন্য এক মিনিট নীরবতা পালন করা হলেও সর্বোচ্চ ধর্মীয় সম্প্রীতি দেখাতে নিউজিল্যান্ড পালন করল দুই মিনিট নীরবতা, যা বিশ্বের ইতিহাসে নতুন ধর্মীয় সম্প্রীতির ধারণা।
নিউজিল্যান্ড শুধু শান্তির দেশ হিসেবে নয়, বরং অসাম্প্রদায়িক দেশের একমাত্র ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী মডেল হিসেবে বর্তমান বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীসহ তার দেশের জনগণ এক সপ্তাহজুড়ে পুরো বিশ্বকে যা দেখিয়েছে, তা পুরো মুসলিম বিশ্ব ও জাতি শ্রদ্ধাভরে আজীবন স্মরণ করবে। ক্রাইস্টচার্চে নামাজরত অবস্থায় শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী হামলায় ৫০ জন মুসলিম নিহত ও ৪০ জন আহত হওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে যে শোকের রক্তক্ষরণ হয়েছে, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও তার দেশের জনগণের গৃহীত কার্যক্রম মুসলিম জাতির সেই রক্তক্ষরণের পরিবর্তে ত্রাণকর্তা হিসেবে মনে জায়গা করে নিয়েছে। এ দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত নিউজিল্যান্ড যেসব কর্ম সম্পাদন করে চলেছে, তাতে দিন দিন নিউজিল্যান্ডের প্রতি মুসলমানসহ সবার মুগ্ধতা বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে নিউজিল্যান্ড মানুষের মন জয়ের এক কারখানা। জাদুর মতো মানুষের ক্ষোভ আর শোককে মুগ্ধতায় পরিণত করা নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অরডানকে নিয়ে বিশ্বের মানুষের মধ্যে বিস্ময়ের শেষ নেই। বিশ্বের সবাই জাসিন্ডার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মাত্র ১ শতাংশ জনগণের জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও তার জনগণ যেভাবে তাদের মনের দরজা খুলে দিয়েছে, তাতে নিউজিল্যান্ডকে মানুষের মন জয়ের স্বর্গ বলে ধরে নিতে হবে। বিশ্ববিবেক নিউজিল্যান্ড ও তার জনগণ থেকে এ বিষয়গুলো শিক্ষা গ্রহণ করার দৃঢ় সংকল্প ও শপথ করা উচিত- মানবজাতিকে শান্তিতে বসবাস করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যেভাবে পরিকল্পনা নিয়েছেন, তার জনগণ সেভাবেই তা পালনে ব্রত হলেন! যেখানে তাদের মনে আসেনি কোনো ধর্মীয় সংশয়, বিদ্বেষ কিংবা রেষারেষি। এর মধ্য দিয়ে কেবল বার বার এমনটি মনে হচ্ছে, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে স্বর্গীয় দূত আর তার জনগণকে অনুগত সহচর হিসেবে স্বয়ং ঈশ্বর এ ধরনের মানবতা ও মানুষের মন জয় করার জন্যই পাঠিয়েছেন। আর তিনি যে প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন, এটি সাধারণ মানুষের পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব বলে মনে হয়।
বিশ্ব যখন ধর্মীয় বিদ্বেষ আর আধিপত্য বিস্তারে মত্ত, নিউজিল্যান্ড ও তার দেশের সব ধর্মের জনগণের মুসলিম প্রার্থনাস্থল হ্যাগলি পার্কে অবস্থান পুরো বিশ্বে বিরল এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এ বিরল দৃষ্টান্ত বিশ্বনেতাদের জন্য এক দারুণ শিক্ষা। মানবতা ও ধর্মীয় সহিষ্ণুতার একমাত্র রোল মডেল জাসিন্দা আরডানের নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বের কোনো নেতাকে মানবতা, অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, ভালোবাসা ও ইস্পাতের মতো ঐক্যের বিষয়ে কোনো শিক্ষা নিতে হলে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ও তার দেশের জনগণ থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথা এক নম্বরে রাখতে হবে। জাসিন্ডা আরডান বিশ্ববাসীর কাছে যে অহিংস বার্তা দিয়েছেন, তা ভারতবর্ষে পরিচালিত গান্ধীর অহিংস নীতির পুনর্জাগরণ বলা যেতে পারে। জাসিন্ডা আরডান শুধু নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীই নন, বরং তিনি বর্তমান বিশ্বের মানবতা, ঐক্য, অসাম্প্রদায়িক, সহমর্মিতার এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। যেখানে কোনো ধর্ম কিংবা বর্ণ দ্বারাই সমাদৃত হননি; বরং প্রশংসিত হচ্ছেন সব ধর্মের, গোত্রের, সব বর্ণের মানুষের।
মুসলিম নারীরা হিজাব পরলে পুনরায় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হতে পারেন এমন আশঙ্কা থাকায় যখন মুসলিম নারীরা শঙ্কিত, তখন ‘হেডস্কার্ফ ফর হারমনি’ নামক আন্দোলন মুসলিম নারীদের পাশে থেকে তাদের নিরাপদে রাস্তায় চলাফেরা করার প্রতি পুরো নিউজিল্যান্ড যে সম্মান দেখিয়েছে, তাতে পৃথিবীর যে কোনো ঐক্য কিংবা ঐক্যের ডাককে এ আন্দোলন হার মানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বর্গীয় প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা অনেকের মন কেড়েছেন। তার মতে, ‘কেন আমি আজ মাথা ঢেকেছি? প্রথম কারণ হচ্ছে, যদি কেউ বন্দুক তুলে কাউকে নিশানা করে তবে আমি তাদের মাঝে দাঁড়িয়ে যাব। আমি চাই সে যেন পার্থক্য করতে না পারে; কারণ আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের অধিনায়কের হ্যাশট্যাগে হ্যালো ব্রাদার, মার্চ ফর লাভ র্যালি এবং ক্যাম্পবেলের জাতীয় পতাকার রুপালি ফার্ন পাতাতে মুসলমানদের প্রার্থনারত আলপনা অংকনের মধ্য দিয়ে স্বর্গীয় ঐক্যের সুরের স্বাদ পেল জাতি।
সর্বশেষ নিউজিল্যান্ডের সংবাদমাধ্যমকে ধন্যবাদ, তারাও এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে থেকে অধিকাংশ পত্রিকাগুলোতে সালাম, শান্তি প্রভৃতি লিখে মাস্টহেড লাইন করার জন্য। তবে যেসব নেতা কিংবা গণমাধ্যম বিদ্বেষপূর্ণ আদর্শ প্রচার করে, তাদের বিরুদ্ধে ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় এ ধরনের হামলা পুনরায় ঘটনার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জাসিন্ডা আরডানকে হয়তো নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনেকে দাবি জানাবেন, আমিও সে দাবির সঙ্গে দৃঢ় মনোভাব পোষণ করি।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
adil_jnu@yahoo.com