চাঞ্চল্যকর অনেক মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়ছে না বছরের পর বছর ধরে। এ নিয়ে বিচারপ্রার্থীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে হতাশার। বিশেষজ্ঞদের মতে, হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া না হলে হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট আলামত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
অভিযোগ রয়েছে, দশ বছর পরও সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যা মামলা তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েনি। আদালত থেকে দফায় দফায় সময় বেঁধে দেওয়ার পরও এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করে প্রতিবেদন দিতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। প্রসিকিউটর ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, আর কোনো মামলার প্রতিবেদন জমা হতে এত দীর্ঘ সময় লেগেছে বলে তাদের জানা নেই। ‘ক্লু-লেস’ মামলার তদন্তে সময় লাগলেও বছর চারেকের মধ্যেই সেগুলোর সমাধান হতে দেখা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসলামবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যা মামলার প্রতিবেদন ৮ বছরেও আদালতে জমা হয়নি। ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আসতেও সময় নিয়েছে চার বছর। আদালতে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার প্রতিবেদন জমা দিতে তিন বছর লেগেছে তদন্ত সংস্থার। সাগর-রুনি হত্যা মামলার জন্য গত ১০ বছরে আদালত থেকে ৮৩ বার সময় নিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। তবু আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের কিনারা করতে পারেনি র্যাব।
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় খুন হন মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি। পরদিন ভোরে তাদের ক্ষতবিক্ষত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেদিন রাতে রুনির ভাই নওশের আলম রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসায় দুর্বৃত্তদের হাতে খুন হন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের ইসলামবিষয়ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী। এ হত্যা মামলার প্রতিবেদন ৮ বছরেও আদালতে জমা হয়নি।
ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আসতে সময় নিয়েছে চার বছর। ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়। চার বছর পর ২০১৯ সালের শুরুর দিকে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। চলতি বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করা হয়।
প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার প্রতিবেদন আদালতে তিন বছর পর জমা দিয়েছে তদন্ত সংস্থা। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর দুপুরের পর রাজধানীর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় দীপনকে। দীর্ঘ তিন বছর পর তদন্ত শেষে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। পরে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশক দীপন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
চলতি বছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। পাঁচ বছরে আলোচিত এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বদলেছে পাঁচ বার। তবু কোনো আসামি শনাক্ত হয়নি। সূত্র জানায়, এখন মামলাটির দায়িত্বে আছেন ঢাকা পিআইবি-এর ডিআইজি। সর্বশেষ ১৮ ডিসেম্বর পাওয়া তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত তদন্তেই ঝুলে আছে মামলা। অগ্রগতি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ তনুর পরিবার। তাদের অভিযোগ, ‘ক্ষমতা’ না থাকায় আজ তারা বিচার পাচ্ছেন না।
২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরে একটি কালভার্টের ২০-৩০ গজ দূরে একটি ঝোপ থেকে উদ্ধার করা হয় তনুর লাশ। পরদিন বিকালে তনুর বাবা কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের অফিস সহকারী ইয়ার হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি মডেল থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ঢালিউডের এই সুপারস্টারের মৃত্যু নিয়ে যে রহস্য তৈরি হয়, তার জট খুলতে লেগে যায় ২৫ বছর। শেষ পর্যন্ত চলতি বছর ৩১ অক্টোবর ঢাকার আদালতে এই মামলা পরিসমাপ্ত হয়।
সালমান শাহ আত্মহত্যাই করেছেন-মর্মে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) দেওয়া প্রতিবেদন গ্রহণ করেন ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ। একইদিনে সালমান শাহর মায়ের পক্ষে আইনজীবীর করা নারাজি ও মা নীলা চৌধুরীর জবানবন্দি গ্রহণের আবেদন খারিজ করে দিয়ে মামলাটির পরিসমাপ্তি টানেন আদালত।
গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্তের অগ্রগতি জানতে চান। ৫ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব ফোর্সেস সদরদপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালের ৭ জুলাই থেকে মামলাটি তদন্ত করছেন তিনি। আগের কর্মকর্তা আটজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছিলেন। তাদের ছয়জন জেল-হাজতে, দুজন জামিনে মুক্ত। জব্দকৃত আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আইএফএস (ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিস)-এ পাঠানো হয়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, আলামতে অজ্ঞাতনামা দুই পুরুষ ব্যক্তির ডিএনএও পাওয়া গেছে। তদন্তকালে তাদের চিহ্নিত করতে প্যারাবন স্ন্যাপশট নামের আরেকটি আমেরিকান ডিএনএ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে।
এ মামলায় সর্বশেষ গত ২৪ নভেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য ছিল। কিন্তু তদন্ত সংস্থা প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় আগামী ২৬ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়।
মামলার অগ্রগতি নিয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু বলেন, সাগর-রুনি মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনো কোনো ক্লু পাচ্ছেন না। তাই বারবার প্রতিবেদন পিছিয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো আসামির সম্পৃক্ততা না-ও পাওয়া যায়, তবু দ্রুত একটি প্রতিবেদন দেওয়া হোক। আর কোনো মামলার তদন্তে এতো সময় লাগতে দেখেননি উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো মামলাই একেবারে ‘ক্লু-লেস’ থেকে যেতে পারে না।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার বলেন, এ ধরনের হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দ্রুত দেওয়া না হলে হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট আলামতগুলো নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।