হার্ট বা হূদযন্ত্র হলো মানুষের প্রাণশক্তি। হূদযন্ত্রের দুর্বলতা জীবন ও সুস্থতার ক্ষেত্রে অন্যতম ঝুঁকি। তাই সবল হার্ট সুস্থ, স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনযাপনের জন্য আবশ্যিক বিষয়। আমরা সচেতনভাবেই শরীরের নানান সুস্থতার বিষয়ে কিছুটা যত্নশীল হলেও হার্ট বা হূদযন্ত্রের সুস্থতায় অনেকটাই উদাসীন। অথচ যার সঙ্গে জীবন-মরণের বিষয় জড়িত, সে বিষয়টি আমরা অনেক ক্ষেত্রেই অবহেলা বা অবজ্ঞা করে থাকি। বলা হয়ে থাকে, অসংক্রামক ব্যাধিগুলোর মধ্যে আক্রান্ত ও মৃত্যুঝুঁকির শীর্ষে অবস্থান হূদরোগের। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) ও জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ২০ শতাংশ বয়স্ক মানুষ বিভিন্ন ধরনের হূদরোগে আক্রান্ত। আবার ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ, ১০ শতাংশ করোনারি হূদরোগ, এক দশমিক দুই শতাংশ বাতজ্বরজনিত হূদরোগে ভুগছেন। বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশেরও বেশি ঘটছে অসংক্রামক ব্যাধি হূদরোগের কারণে (সূত্র : ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন রিসার্চ ইনস্টিটিউট)।
২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস। ২০০০ সাল থেকে নানান আনুষ্ঠানিকতায় বিশ্বের ১৯৪টি দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বব্যাপী হূদরোগে মৃত্যুহার সর্বাধিক। প্রতিবেদনে বলা হয়, হূদরোগে প্রতি বছর ১৭ দশমিক ২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এই হার সবচেয়ে বেশি।
ওয়ার্ল্ড হার্ট ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বে প্রতি বছর এক কোটি ৭৫ লাখ মানুষ হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ২০৩০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে দুই কোটি ৩০ লাখে। আর বিশ্বে মোট মৃত্যুর ৩১ ভাগই ঘটে হূদরোগের কারণে।
হার্ট অ্যাটাক কী ও কেন হয়
হার্ট বা হূদযন্ত্র যদি ঠিকমতো কাজ না করে, তবেই হার্ট অ্যাটাক হয়। হার্ট অ্যাটাকে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এই ব্যথা ২০-৩০ মিনিট স্থায়ী হয়। এটিকে মেডিকেল ইমার্জেন্সি বলা হয় কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগী হাসপাতালে পৌছার আগেই মৃত্যুবরণ করে। করোনারি আর্টারি নামে হূৎপিণ্ডের গায়ে থাকে দুটি ছোট ধমনি। এরাই হূৎপিণ্ডে পুষ্টির জোগায়। কোনো কারণে এই করোনারি আর্টারিতে যদি ব্লক সৃষ্টি হয়, তাহলে যে এলাকা ওই আর্টারি বা ধমনির রক্তের পুষ্টি নিয়ে চলে সে স্থানটিতে হূৎপেশি কাজ করে না। আর তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। হূদরোগের অনেক কারণ আছে। প্রাথমিক ও প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে তেলযুক্ত খাদ্য গ্রহণ, অতিরিক্ত ফাস্টফুড খাওয়া, অত্যধিক মানসিক চাপ, রক্তে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া অথবা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে গেলে, খাদ্যে অ্যান্টি অক্সিডেন্টের অভাবে, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস এবং মদ্যপানের কারণে, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ও ওজন বৃদ্ধি পেলেও। তবে সবসময় মনে রাখবেন মানসিক চাপ এমন একটি ক্ষতিকর প্রক্রিয়া যা একাই হূদরোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া হার্ট অ্যাটাকের অন্য কারণগুলো- বয়স, লিঙ্গ, বংশগত।
বাঁচতে হলে জানতে হবে
বুকে প্রচণ্ড ব্যথা হলে মনে হবে ভারী কিছু একটা যেন বুকের ওপর বসে আছে। মনে হবে যেন বুক চিপে ফেলছে। ব্যথার ব্যান্ড বুকের চারপাশে অনুভব করবেন। হজম হবে না, পেটের উপরের অংশে জ্বালাপোড়া করবে। অতি দ্রুত ও ছোট ছোট শ্বাস-প্রশ্বাস। ঘেমে যাওয়া। অজ্ঞান হওয়া। চোখে ঝাপসা দেখা, বমি হওয়া ইত্যাদি হার্ট অ্যাটাকের পূর্বলক্ষণ। মনে রাখবেন ব্যথা শুরু হওয়ার পরে এবং অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত ১০ সেকেন্ড সময় থাকে। এমন অবস্থা হলে নিজ চেষ্টায় বার বার জোরে জোরে উচ্চস্বরে কাশি দিন। লম্বা করে শ্বাস নিন। আবার কাশুন এবং দীর্ঘশ্বাস নিন। বার বার এমন করলে ফুসফুসে স্পাটাম/মিউকাস উৎপন্ন হবে, আপনি পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাবেন। কাশির ফলে আপনার হূদযন্ত্র সংকোচন-প্রসারণ হবে। তাহলে হূৎপিণ্ডের ভেতর দিয়ে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।
হার্ট ভালো রাখতে কী করবেন
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটুন অথবা ব্যায়াম করুন। শারীরিক পরিশ্রম করুন। মানসিকভাবে আনন্দে থাকার চেষ্টা করুন। ধূমপানসহ সব ধরনের নেশামুক্ত জীবনযাপন করুন। দুশ্চিন্তামুক্ত হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করুন। রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখুন। ডায়াবেটিস ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখুন। চর্বিজাতীয় খাদ্য কম খান। শাকসবজি, ফলমূল বেশি খান। দেহের অতিরিক্ত ওজন কমান। চিকিৎসকদের মতে, হার্ট ভালো রাখতে হলে লবণ কম খান। ধূমপান এড়িয়ে চলুন। সুষম খাবার খান আর প্রাণখুলে হাসুন। নিয়মিত ব্যায়াম, রক্তচাপ ও ওজন নিয়ন্ত্রণ, মদ্যপান পরিহার করুন। সবসময় কর্মচঞ্চল থাকুন। নিজেকে সামাজিক কাজে যুক্ত করুন। সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমান। নিয়মিত ডাক্তারের কাছে যান। আর হার্ট সুস্থ রাখতে যেসব খাবার এড়িয়ে যাবেন- মগজ, ডিমের হলুদ অংশ, কলিজা (গরু/খাসি), চিংড়ি, বিশেষ করে বড় চিংড়ি, আইসক্রিম, চকোলেট, খাসির মাংস, হাঁসের মাংস, গরুর মাংস, মুরগির চামড়া, দুধের সর খাবেন না বা যথাসম্ভব কম খাবেন।
সুস্থ হার্টের প্রয়োজনীয় খাবার
হূদরোগীদের স্বাস্থ্যকর খাওয়ার তেলের মধ্যে রয়েছে- সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, অলিভ অয়েল এবং যে তেলগুলো হূদরোগীর জন্য ক্ষতিকর সেগুলো হলো- পামঅয়েল, নারিকেল তেল ও পাম কার্নেল। এ ছাড়া কোলেস্টেরল দুই রকম হয়। একটি হলো LDL বা খারাপ এবং অন্যটি HDL বা ভালো কোলেস্টেরল। রক্তে LDL কোলেস্টেরলের মাত্রা ১০০ মিলি গ্রাম/DL’র নিচে রাখতে হবে। আর যাদের ধমনিতে রিং লাগানো আছে বা বাইপাস করা আছে, তাদের জন্য ধূমপান সর্বনাশা। ধূমপানে বাইপাস ও রিং হঠাৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। সাধারণ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর হার ৫-১০ শতাংশ। আর হঠাৎ রিং বন্ধ হয়ে মৃত্যুর হার ৪০-৪৫ শতাংশ। শাকসবজি, সব ধরনের দেশি টাটকা ফল, সব ধরনের মাছ, বিশেষত সামুদ্রিক মাছ, সূর্যমুখীর তেল, জলপাইয়ের তেল, মাছের তেল (পাম অয়েল এবং নারকেল তেল/দুধ ছাড়া)।
বুকে ব্যথা হলেই কি হার্ট অ্যাটাক
অনেকেরই ধারণা, বুকে ব্যথা মানেই হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকের একটি উপসর্গ হলো বুকে ব্যথা। তবে সবধরনের বুকব্যথা মানেই হার্ট অ্যাটাক নয়। কারণ অন্য অনেক কারণেও বুকে ব্যথা হতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে বুকে ব্যথা হলো হার্ট অ্যাটাকের প্রধান ও প্রথম লক্ষণ। তাই বলে বুকে ব্যথা হলে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ নয় এমন অবহেলাও কাম্য নয়। চিকিৎসা গবেষকদের মতানুযায়ী, অনেক সময় ফ্রোজেন শোল্ডার অ্যাটাক হলে বুকে ব্যথা হয়। এক্ষেত্রে কাঁধে প্রচণ্ড ব্যথা হয় এবং বুক চেপে আসে। গ্যাসের সমস্যার কারণেও বুকে চাপ ও ব্যথা হয়। এটা খুবই পরিচিত একটা সমস্যা। বিষয়টি খুব দুশ্চিন্তার না হলেও সমস্যা খুব ঘন ঘন দেখা দিলে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। আবার ঠিক হার্ট অ্যাটাক নয়, তবে হূদযন্ত্রে অন্য কোনো সমস্যা থাকলেও বুকে ব্যথা হতে পারে। এটাকে করোনারি আর্টারি ডিজিজ বলা হয়। এ ধরনের সমস্যা থাকলে হূৎপিণ্ডের পেশিতে রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণেও বুকে ব্যথা হয়।
হার্ট নিয়ে ভ্রান্ত-বিশ্বাস
হার্টের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিয়ে অনেকের মধ্যে কিছু ভুল ধারণা ও ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রচলিত আছে। যেমন- হার্টে সমস্যা থাকলে ব্যায়াম করা উচিত নয়। কিন্তু গবেষণা বলছে, ব্যায়াম দ্বিতীয় অ্যাটাকের সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। অনেকে ধারণা করেন, কোলেস্টেরল বা প্রেশার বেশি থাকলে নিজেই টের পেতাম। শুধু শুধু মাপানোর কী প্রয়োজন! কিন্তু চিকিৎসা গবেষকরা বলছেন, কোলেস্টেরল বা প্রেশারকে বলা হয় ‘সাইলেন্ট কিলার’ বা নীরব ঘাতক। এদের কোনো বাহ্যিক লক্ষণ থাকে না। কেউবা মনে করেন, ঠিকমতো ডায়াবেটিসের ওষুধ খেলে হার্ট নিয়ে আর চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু সুগার নিয়ন্ত্রণে থাকলে হাই সুগার থেকে কিডনি বা চোখের রোগ নিয়ে ভয়ের কিছু নেই একথা ঠিক হলেও বড় রক্তনালিগুলোর (যেগুলো হার্টের সঙ্গে যুক্ত) সুগারের চাইতে ব্লাড প্রেশার ও কোলেস্টেরলের সঙ্গে বেশি সম্পর্কযুক্ত। তাই ব্লাড প্রেশার ও কোলেস্টেরল ঠিক না থাকলে, শুধু সুগার নিয়ন্ত্রণ করেই হার্টের রোগের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া সম্ভব নয়। অনেকের ধারণা, ধূমপানে ক্যানসার হয়- হার্টের রোগ নয়। মনে রাখুন, ধূমপায়ীদের হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ অধূমপায়ীদের তুলনায় দ্বিগুণ। কারণ ধূমপান রক্তনালি সরুকরণে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। আবার কেউ মনে করতে পারেন অনেক বছর ধরে ধূমপান করলে ধূমপানের অভ্যাস ছাড়লে এখন আর হার্টের উন্নতি হবে না। এই ধারণাটিও ভুল। এক্ষেত্রে আশার খবর হলো, ধূমপান ছাড়ার এক বছরের মধ্যে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ৫০ ভাগ কমে যায়। পনেরো বছর পরে এই ঝুঁকি অধূমপায়ীর সমান হয়। আরো জেনে রাখুন, হার্টের রোগ কেবল পুরুষদেরই হয় না, ৬৫-এর বেশি বয়সে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি নারী ও পুরুষের সবারই সমান। হার্টের রোগ বংশগত হলেও ব্যায়াম, স্বাস্থ্যকর খাবার ও ধূমপান ত্যাগের মাধ্যমে রোগের ঝুঁকি অনেক কমানো যায়। কারো মনে হতে পারে, বুকে তীব্র ব্যথা না হলে এটি হার্ট অ্যাটাক নয়। আসলে হালকা ব্যথার সঙ্গে দমবন্ধ ভাব, শ্বাসকষ্ট, ঘাম, বমি, মাথাব্যথা থাকতে পারে। হার্ট অ্যাটাক বুঝতে পেরে সঠিক সময়ে ডাক্তারের কাছে যেতে পারলে ৯৫ ভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে বাঁচানোর সুযোগ থাকে।