অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে ১০ থেকে ১২ হাজার টন শুঁটকি তৈরি হয়, যার অধিকাংশ প্রাকৃতিক উপায়ে বা রৌদ্রে শুকিয়ে তৈরি করা হয়। বর্তমানে বেশ কিছু স্থানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত মানের শুঁটকি তৈরি করে বাজারজাত ও রপ্তানি হচ্ছে। প্রতি বছর কমবেশি ২০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানিকারকদের অভিমত, এক্ষেত্রে সরকার প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিলে বিদেশে শুঁটকি মাছ রপ্তানি করে বছরে হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। আশার খবর হলো, শুঁটকি এখন শুধু সুস্বাদু খাবার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে না, দেশের পোলট্রি এবং মৎস্য খামারে শুঁটকি ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হচ্ছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই)-এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. জলিলুর রহমান উদ্ভাবিত নতুন প্রযুক্তির ড্রায়ার ‘বিএফআরআই ফিশ ড্রায়ার’-এর মাধ্যমে স্বাস্থ্যসম্মত ও উন্নত গুণগত মানসম্পন্ন শুঁটকি মাছ তৈরি করা সম্ভব। বেসরকারি সংস্থা কোস্ট ট্রাস্টের মৎস্য উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. শফিউদ্দিন মশারির জাল দিয়ে ঢাকা ট্যানেল প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন। এই প্রযুক্তির ট্যানেল তৈরিতে ব্যয় অন্য প্রযুক্তিগুলোর তুলনায় অত্যন্ত কম ও ব্যবহার পদ্ধতি খুবই সহজ এবং উৎপাদনকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্য। প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পাশাপাশি শুঁটকি খাতের অন্যান্য সংকটেরও সমাধান করতে হবে। শুঁটকি ব্যবসায়ীদের মতানুযায়ী সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে, জেলেদের দাদনমুক্ত করা গেলে এবং শুঁটকি বাজারজাতকরণের সমস্যাসমূহ দূর করতে পারলে উপকূলের শুঁটকি বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।
খুরুশকুলে আধুনিক শুঁটকি মহাল
মৎস্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২-এর আওতায় ৪৫ একর জমির ওপর কক্সবাজারের খুরুশকুলে একটি আধুনিক শুঁটকিমহাল ও ইটিপি স্থাপনের প্রাথমিক কাজ শুরু হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ থেকে খুরুশকুলে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের মধ্যে ৫০ টনের আইস প্ল্যান্ট, মৎস্য অবতরণ ও প্রক্রিয়াকরণ শেড, ২৪৫০টি গ্রিনহাউস বেসড মেকানিক্যাল ড্রায়ার, ৫০টি সেমি মডার্ন মেকানিক্যাল ড্রায়ার ৫০০ ও ৩০০ টনের দুটি কোল্ডস্টোরেজ, কোয়ালিটি কন্ট্রোল ল্যাব, ফিশমিল ও ফিশ ওয়েল প্ল্যান্ট ও মেশিন রুম নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ড্রাইফিশ মার্কেট, মাল্টিপ্লেক্স বিল্ডিং, কনভেয়র বেল্ট (জেটি হতে ল্যান্ডিং স্টেশন), ট্রাক পার্কিং, প্যাকেজিং ফ্যাক্টরি, ইলেক্ট্রিক সাবস্টেশন ও জেনারেটর হাউজ, চারটি টয়লেট জোন, ইটিপি ও ডব্লিউটিপি স্থাপন এবং ২৪ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রোড-নেটওয়ার্কও তৈরি করা হবে।
উপকূলজুড়ে শুঁটকির বিরাট সম্ভাবনা
মাছ শুকিয়ে শুঁটকি বানানোর প্রথা অনেক পুরোনো হলেও বাণিজ্যিকভাবে এর উৎপাদন হয় মূলত দেশের উপকূলীয় এলাকাতেই। উপকূল এলাকায় কয়েক মাস ছাড়া বছরের বাকি সময়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি তৈরি হয় শীতে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে শুঁটকি উৎপাদন করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার শুঁটকি মাছ রপ্তানির আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী দেশে ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি করা হয়। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬২৩ টন শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। বরগুনার লালদিয়া, আশারচর, সোনাকাটা, জয়ালভাঙ্গা চরের, শুঁটকিপল্লিতে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত ৬ মাস ধরে চলে শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরনের কাজ। শুঁটকিকে কেন্দ্র করে উপকূলীয় হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবীর আনাগোনায় মুখরিত থাকে এসব চর। গভীর সাগর থেকে জেলেরা মাছ নিয়ে দেশের বৃহত্তম মৎস অবতরণ কেন্দ্র পাথরঘাটা (বিএফডিসি) ঘাটে ভিড়ছেন। কুয়াকাটায় শুঁটকি উৎপাদনের এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে-সৈকতের পশ্চিম দিকে মাঝিবাড়ি, খাজুরা, খালগোড়া, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর ও ধুলাসার। শুঁটকি মৌসুমে সমুদ্র থেকে আহরিত লইট্টা, ফাহা, ফালিসা, চাবল, কোরাল, হাঙ্গর, ছুরি, পোমা, চান্দাকাটা, চিংড়ি, লাক্ষ্মা, নোনা ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের শুঁটকি করা হয় কুয়াকাটায়।
হাজার কোটি টাকার রপ্তানি বাজার
আশার খবর হলো, প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মধ্যে বিশাল পরিমাণে শুঁটকি রপ্তানি হচ্ছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় উৎপাদিত শুঁটকি অত্যন্ত সীমিত পর্যায়ে বেসরকারিভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, ব্রিটেন, আমেরিকা, চীন, হংকং, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। জাপান, চীন, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়াসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ এবং আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশেও শুকনো মাছ বা শুঁটকির জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেসব দেশেও বাংলাদেশের শুঁটকি রপ্তানি সম্প্রসারিত হতে পারে। রপ্তানিকারকদের মতে, সরকার এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিলে বিদেশে শুঁটকি মাছ রপ্তানি করে বছরে ১০০০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।
অন্যতম শুঁটকির গ্রাম কক্সবাজারের নাজিরারটেক
কক্সবাজার জেলার নাজিরারটেক এলাকায় বেসরকারিভাবে এরই মধ্যেই গড়ে উঠেছে দেশের সর্ববৃহৎ শুঁটকিপল্লি। শীত মৌসুমে এই এলাকায় ব্যস্ততা বাড়ে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শুকিয়ে প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকেন শ্রমিকরা। এ সময় শ্রমিকদের পাশাপাশি ব্যস্ত থাকেন মহাল মালিকরাও। বৃষ্টির মৌসুমে কোনো কাজ হয় না। এ বিষয়ে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অবকাঠামো উন্নয়নসহ শুঁটকিমহালের আধুনিকায়নে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখানে একটি আধুনিক শুঁটকিমহাল গড়ে তুলতে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। দেশের বৃহত্তম শুঁটকিমহাল এটি। এখান থেকে প্রতি বছর সরকারকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব দেওয়া হলেও শুঁটকিমহালে সুযোগ-সুবিধা তেমন নেই বললেই চলে। বিশেষ করে অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে শুঁটকির উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। কক্সবাজার শহর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বঙ্গোপসাগরের পাশ ঘেঁষে প্রায় ১০০ একর বালুচরজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে নাজিরাররটেক শুঁটকিমহাল। শুধু সূর্যের তাপে বিভিন্ন ধরনের মাছ শুকানো হয়। তবে উদ্বেগের বিষয়, পোকামাকড় থেকে রক্ষা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এসব শুঁটকিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। শুধু নাজিরারটেক নয়, প্রতি বছরের মতো শীত মৌসুমের শুরু থেকে মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়াসহ জেলার উপকূলীয় বিভিন্ন শুঁটকিমহালে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়েছে। সাগরের বেড়িবাঁধ এবং বিশেষ উপায়ে তৈরি বাঁশের মাচার ওপর পাতলা করে বিছিয়ে সূর্যের তাপে কাচা মাছ শুকিয়ে শুঁটকিতে পরিণত করা হয়। সম্প্রতি নাজিরারটেক শুঁটকিমহালে গেলে দেখা যায়, প্রতিটি শুঁটকিমহালে শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। কেউ মাছ পরিষ্কার করছেন, কেউ মাচায় তুলছেন। কথা বলারও ফুরসত নেই তাদের।
লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং
উন্নয়ন গবেষক