বাংলাদেশের ইতিহাসে ১০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২ মিনিট-এ ক্ষণটি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। পদ্মা সেতুর ওপরে সর্বশেষ স্প্যানটি বসার মধ্যদিয়ে যুক্ত হলো পদ্মার এপাড়-ওপাড়, তার সঙ্গে যুক্ত হলো সমগ্র বাংলাদেশ। দক্ষিণবঙ্গের কিছু খাল, নদী -নালা বাদ দিলে সড়কপথে আজ পুরো বাংলাদেশ এখন সংযুক্ত।
রেলসংযোগ সড়কসহ সেতুর আরো অনেক খুচরো কাজ বাকি। সেগুলো শেষ করতে হয়তো আরো বছরখানেক সময় লাগবে। কিন্তু প্রমত্তা পদ্মাকে বশ মানাতে মূল যে কাজ ছিল নদীশাসন আর সেতুর পিয়ারের ওপরে স্প্যান বসানো সেই কঠিন আজ সম্পন্ন হলো।
দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও দেশের পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগের উন্নয়নে যমুনানদীর ওপর ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ পদ্মানদীর ওপর সেতু নির্মাণের দাবি তোলে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৯৯৯ সালে একটি প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মধ্যদিয়ে পদ্মা সেতুর পরিকল্পনা প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার অর্থ সংগ্রহের জন্য সেতু বিভাগ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অর্থায়নের জন্য এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাপান দূতাবাসে পত্র প্রেরণ করে। জাপান সরকার ইআরডির প্রস্তাবে সম্মত হয়ে ২০০১ সালের ৪ ডিসেম্বর চুক্তি স্বাক্ষর করে। সমীক্ষায় ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৫৩ কোটি টাকা।
২০০১ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় আসতে না পারলেও এ সেতুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ অব্যাহত ছিল। ২০০৩-০৫ সালে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পয়েন্টে এবং শরীয়তপুর জেলার জাজিরা পয়েন্টে সেতুর স্থান নির্বাচন করে। ২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হলে প্রকল্পটি কারিগরি ও অর্থনৈতিক দিকে থেকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। পদ্মা সেতুর নির্মাণের পাশাপাশি আলাদা লাইনে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ স্থাপনের পরিকল্পনাও হয়।
২০১১ সালে সেতুতে রেলপথ সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ দশমিক ০২ কোটি টাকা অর্থাৎ ৭৯ দশমিক ৮৯ ভাগ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫০ ভাগ। সেতু বিভাগের তথ্য মতে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূলসেতুর কাজ বাস্তবায়নে অগ্রগতি ৯১ ভাগ, আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৩৮ ভাগ এবং সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়া বাস্তবায়ন শতভাগ এগিয়েছে। তবে সেতুর কাজে সবসময়েই ছিল অনেক চ্যালেঞ্জ। এসব চ্যালেঞ্জিং কাজের মধ্যে প্রথমেই ছিল প্রকল্পের অর্থ-সংস্থান।
২০১০ সালে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। পরে অন্য দাতারাও সেটি অনুসরণ করে। পরবর্তীতে দুর্নীতি অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। কোনো প্রমাণ না পাওয়ায় কানাডার আদালত পরবর্তীতে মামলাটি বাতিল করে দেয়। বর্তমানে প্রকল্পটি বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করা হচ্ছে।
এ সেতুকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে দক্ষিণাঞ্চলের পদ্মা সেতুসংলগ্ন এলাকা মাদারীপুরের শিবচরের মানুষ। পিছিয়েপড়া জনপদের উন্নয়নের সঙ্গে বাড়বে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবে এ অঞ্চল। পদ্মা সেতুকে ঘিরে অনেক স্বপ্ন এবং উচ্ছ্বাস মাদারীপুর জেলার শিবচর এলাকার মানুষের মধ্যে।
সরেজমিনে ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, পদ্মা সেতুর একপ্রান্ত শরীয়তপুরের জাজিরা এবং মাদারীপুরের শিবচরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলগামী পরিবহন সেতু পার হয়ে জাজিরাপ্রান্তে নেমে শিবচরের ওপর দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছে যাবে। আর এই সেতুকে ঘিরেই এসব অঞ্চলের অবহেলিত জনপদে এখন উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রত্যন্ত জনপদে গত ১৫ বছর আগেও যেখানে ছিল না কোনো রাস্তা, কাদামাটি-পানি পেরিয়ে ঘরে ফিরতে হতো সাধারণ মানুষের, জরুরি প্রয়োজনে কোথাও দ্রুত যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না সেসব এলাকাতে এখন দেশের অন্যতম সড়কের ছোঁয়া।
রাস্তাঘাট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাট-বাজার, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়ে প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে এখন শহুরে স্পর্শ। জীবনমানের রাতারাতি এ পরিবর্তনে বিস্মিত এলাকার মানুষ। অভিভূত এবং আনন্দিত। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই রাতারাতি পাল্টে যেতে থাকে মাদারীপুর জেলার শিবচরসহ আশপাশের এলাকার চিত্র।
পদ্মা সেতুর জন্য তৈরিকৃত অ্যাপ্রোচ সড়কের কারণে জাজিরা পয়েন্ট থেকে শিবচর উপজেলার পাঁচ্চর পর্যন্ত যোগাযোগের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। অ্যাপ্রোচ সড়কটির জন্য আশপাশের এলাকার উন্নয়ন হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে পাকা রাস্তা। বিশেষ করে পদ্মা সেতু ও সড়ক নির্মাণের জন্য পরিবহনের সহজ যোগাযোগ তৈরি করতে এমনিতে নির্মাণ করতে হয়েছে রাস্তা-ঘাট। এর ফলেই প্রত্যন্ত গ্রামগুলো পেয়েছে আধুনিক সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। এর ফলে দ্রুততার সঙ্গে এসব এলাকার ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসারও বাড়তে থাকে।
শিবচর উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সেতুকে ঘিরে মাদারীপুর জেলার শিবচরের চরাঞ্চলে এখন উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে যুক্ত এক্সপ্রেসওয়ে শিবচরের ওপর দিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই এক্সপ্রেস হাইওয়ের পাশে নতুনভাবেই গড়ে উঠেছে কমপক্ষে ১০টি বাজার। পুরানো হাট-বাজারগুলোতেও আধুনিকতা এসেছে। তাছাড়া রেললাইনের দুইটি স্টেশনও শিবচরে হচ্ছে। আর এই স্টেশনকে ঘিরেই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠবে। সহজেই দূর-দূরান্ত থেকে কম খরচে মালামাল বহন করতে পারবে।
পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করেই শিবচরে ১০৮ একর জায়গায় ১৯শ কোটি টাকা ব্যয়ে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মাণ হবে। ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, এক হাজার ৬৪টি প্লট নিয়ে দাদা ভাই হাউজিং প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে, সম্প্রতি চালু হয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম তালুকদার টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
পদ্মাপাড়ের ৭৫ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা ইনস্টিটিউট ফর ফন্ট্রিয়ার টেকনোলজি, ৪শ একর জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে শিবচর ইউনিয়নে বিসিক শিল্পনগরী স্থাপনের। ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমি ও সংস্কৃতি কেন্দ্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে পৌরসভা-সংলগ্ন এলাকায়। মহাসড়কে ট্রমা সেন্টার নির্মাণ শুরু হয়েছে। নির্মিত হবে কর্মজীবী মায়েদের জন্য বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলসহ ট্রেনিং সেন্টার ও ডে-কেয়ার সেন্টার। আধুনিক কাঁচাবাজারসহ শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু হচ্ছে শিগগিরই।
স্থানীয়রা জানান, সেতু চালু হলে এখানে উৎপাদিত নানা ধরনের পণ্য রাজধানী ঢাকায় সহজেই পৌঁছানো যাবে। আবার ঢাকা থেকে সহজেই যে কোনো কিছু এখানে নিয়ে আসা যাবে। এতে করে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রসারতা হবে। লাভবান হবে এলাকার মানুষ। শিবচর থেকে তখন ঢাকার দূরত্ব হবে মাত্রা ৪০ মিনিট। সেতুর কারণে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এ এলাকা এগিয়ে যাবে।