রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নিধনযজ্ঞের এক বছর পূরণ হলো আজ। বিশ্বজুড়ে আলোচিত রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ আন্তরিকতার সঙ্গে অগ্রসর হলেও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার। লোক দেখানো আলোচনা এবং নানা দুরভিসন্ধির মধ্য দিয়ে কালক্ষেপণ করছে দেশটি। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) সঙ্গে চুক্তি করলেও তা বাস্তবায়নে কোনোই ইচ্ছা নেই তাদের। এমনকি অতীতের ধারাবাহিকতায় আবারো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দায় উল্টো বাংলাদেশের ঘাড়েই চাপিয়েছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হওয়ার জন্য সম্প্রতি সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশকেই দোষারোপ করেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, আবারো রাখাইনে তথাকথিত সন্ত্রাসী হামলার ইঙ্গিত দিয়েছেন সুচি। তার এ ধরনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, চীন-রাশিয়ার মতো শক্তি দেশটির পক্ষে থাকায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ অনেক ক্ষেত্রে ফল পাচ্ছে না। আর ২০১৯ সালে দেশটির জাতীয় নির্বাচনের পর সেখানকার সামরিক বাহিনী বা সূচির পলিসি কী হবে তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু। তবে বাংলাদেশ চাইছে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার একটি টেকসই সমাধান। সেই সঙ্গে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ আরো বৃদ্ধি করা। সর্বশেষ রোহিঙ্গা সমস্যার প্রেক্ষাপট এবং তা সমাধানে মিয়ানমারের অনীহার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে দেশটির বিচার দাবি করেছেন আশিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ১৩২ আইন প্রণেতা।
অনমনীয় মিয়ানমার : মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যে আন্তরিক নয় দেশটির সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডেও তার প্রমাণ মেলে। সম্প্রতি দেশটি বাংলাদেশের সীমান্তে নতুন করে মাইন স্থাপন এবং সেনাবাহিনীর ৯-১০টি লাইট ইনফেন্ট্রি ইউনিট মোতায়েন করেছে। রোহিঙ্গা নির্যাতনের এক বছরপূর্তিকে সামনে রেখে মিয়ানমার সরকার উত্তর রাখাইনে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রেখেছে তাদের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। একই সঙ্গে মংডু, বুথিডং শহরে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত বাড়িয়েছে সান্ধ্যকালীন কারফিউর মেয়াদ।
২০১৭ সালের আগস্টে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞের বছরপূর্তিকে সামনে রেখে উত্তর রাখাইন রাজ্যে এখন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। একই সঙ্গে ওই রাজ্যের মংডু, বুথিডং শহরে সান্ধ্যকালীন কারফিউর মেয়াদ আরো দুই মাস বাড়ানো হয়েছে। স্থানীয় কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে মিয়ানমার টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে মধ্যরাতে কারফিউ জারি রয়েছে রাখাইনের এই দুই শহরে। মংডু ও বুথিডং জেলার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা ইউ কিয়াউ উইন হটেট জানান, কারফিউর নতুন মেয়াদ দুই মাস বাড়িয়ে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত বহাল রাখা হয়েছে। রাত ১০টায় শুরু হয়ে কারফিউ জারি থাকবে ভোর ৫টা পর্যন্ত।
এই কর্মকর্তা জানান, নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কারফিউর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ওই অঞ্চলে এখনো অনেক বিষয়ে অগ্রগতি প্রয়োজন। তিনি বলেন, কারফিউয়ের সময়ে পাঁচজনের বেশি মানুষ একত্রিত হতে পারবেন না এবং বাইরে বের হতে পারবেন না।
মিয়ানমারের এসব পদক্ষেপের কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও। তারা জানান, মিয়ানমার নতুন করে বাংলাদেশ সীমান্তে মাইন পুঁতেছে। এর বাইরে নতুন করে তারা ৯-১০টি লাইট ইনফেন্ট্রি ইউনিট মোতায়েন করেছে। তবে মিয়ানমার এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি চাপে রয়েছে, যা তারা ভাবতে পারেনি। তারপরও তারা তাদের মতো করে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
মংডুর স্থানীয় মুসলিমরাও সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়েছে। ২৫ আগস্টকে ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যেও বড় ধরনের উদ্বেগ রয়েছে। স্থানীয় মুসলিম ইউ আরশুট বলেন, আমরা উদ্বিগ্ন। তিনি জানান, দিনের বেলা সবাই নির্বিঘ্নে বাইরে যেতে পারছে। কিন্তু রাতে বের হতে পারছে না।
প্রত্যাবাসনের দায় বাংলাদেশের— সু চি : এদিকে, অতীতের ধারাবাহিকতায় আবারো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দায় বাংলাদেশের ঘাড়ে চাপিয়েছেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি। গত মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশের। মিয়ানমার তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় প্রত্যাবাসনের যাবতীয় পথ রুদ্ধ করে রেখেছে। পাশাপাশি প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার দায় বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে আসছে। কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হওয়া এসব রোহিঙ্গাকে ফেরাতে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমার চুক্তি স্বাক্ষর করলেও এখনো শুরু হয়নি প্রত্যাবাসন। মঙ্গলবারও সিঙ্গাপুর সফররত সু চি তার বক্তৃতায় রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করেন। রোহিঙ্গা শব্দের বদলে তাদের ‘বাংলাদেশে পালিয়ে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া’ মানুষ আখ্যা দেন।
সু চি তার বক্তৃতায় বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরার ব্যাপারে সময়ের কাঠামো নির্ধারণ করা কঠিন। তার দাবি, ঢাকাকেই প্রক্রিয়াটি শুরু করার জন্য প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে। মিয়ানমার নেত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশকেই প্রত্যাবাসনকারীদের ফিরিয়ে দিতে হবে। আমরা কেবল সীমান্তে তাদের স্বাগত জানাতে পারি।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি বাংলাদেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, কত দ্রুত তারা পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে চায়।’
স্থায়ী সমাধান চায় বাংলাদেশ : সঙ্কট সমাধানে অতীতের মতো এ বিষয়ে আর সাময়িক সমাধানের পথে হাঁটছে না বাংলাদেশ সরকার। চাচ্ছে স্থায়ী সমাধান। ১৯৭৮-৭৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গারা আবারো আসতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এবারে রোহিঙ্গারা আর আগের মতো ফেরত যেতে চাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ইউএনএইচসিআর-এর কর্মকর্তা জোসেফ সূর্য ত্রিপুরা।
পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এ ব্যাপারে বলেন, আমরা চাচ্ছি কূটনৈতিকভাবে এ সমস্যার সমাধান। এর অন্য কোনো সমাধান নেই। আমরা এর টেকসই সমাধান চাই। এ জন্য আমরা তাদের দেশে ফেরার পর সেখানে নিরাপদ বসবাস, নাগরিকত্ব এবং কর্মসংস্থানের বিষয়টির ওপর জোর দিয়েছি।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেন, বাংলাদেশ যা করা সম্ভব তার সবই করছে। এর কিছু আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, কিছু পাচ্ছেন না। রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশের যা করা দরকার তার সবই করা হবে।
মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাবেক ডিফেন্স অ্যাটাশে মেজর জেনারেল (অব.) শহিদুল হকও বলেন, ২০১৯ সালের আগে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ, আগামী বছর ওই দেশে জাতীয় নির্বাচন। সেখানে সামরিক বাহিনী বা সূচির পলিসি কী হবে সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আসলে ভারত এ ব্যাপারে উদ্যোগী না হওয়া পর্যন্ত সমাধান পাওয়া কঠিন। আবার চীনও মিয়ানমারকে সাহায্য করছে। ফলে তারা সাহস পাচ্ছে। আমাদের যে চেষ্টা আছে, তাতেই ফল মিলবে বলে আমি আশাবাদী।
ফিরে দেখা : সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে একটি অপরিচিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সন্ত্রাসবিরোধী শুদ্ধি অভিযানের নামে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। দেশটির উগ্রপন্থি বৌদ্ধরাও অংশ নেয় এই নিধনযজ্ঞে। হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ থেকে বাঁচতে দলে দলে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিতে থাকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা। এ সময় অন্তত ৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা বর্তমানে ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। এসব রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।
নিপীড়িত এ জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়ের জন্য বাংলাদেশকে নতুন করে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এমন পরিস্থিতিকে ‘মানবতা ও মানবাধিকারের জন্য দুঃস্বপ্ন’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত বর্বরতাকে ‘জাতিগত নিধনযজ্ঞের পাঠ্যপুস্তকীয় দৃষ্টান্ত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন।
এক বছরেও মিয়ানমারের এই পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। এখনো আশার আলো দেখার মতো, নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হওয়ার মতো অবস্থায় নেই বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লাখ লাখ মানুষ।
উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একপাশে ছিল জাপান, অন্যপাশে ব্রিটিশ সেনা। জাপানিদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে। কিন্তু তাদের সে আশা পূরণ হয়নি। সে সময় ব্রিটিশ সেনাকে সহায়তা করে স্থানীয় নৃগোষ্ঠীগুলো। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল রোহিঙ্গারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও শেষ হয়নি এর উত্তাপ। এরই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে চলে রোহিঙ্গা বিতাড়ন।