ছোট্ট হাতের আঙুলে অজস্র সুঁইয়ের ফুটো। কিন্তু তারপরও একমনে রঙ-বেরঙের সুতোর আলপনা কাঁথায় ফুটিয়ে তুলছে। ৯ বছরের মারিয়া সুঁই সুতোর বন্ধনে ফুটিয়ে তুলছে বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য ও হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ সংস্কৃতি। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মারিয়ার এখন সহপাঠীদের সঙ্গে খেলা-আনন্দে সময় কাটানোর কথা থাকলেও পারিবারিক দৈন্যে সুঁই সুতোর আলপনায় চলে এখন তার শিক্ষাজীবন। পটুয়াখালীর কলাপাড়ার টিয়াখালী ইউনিয়নের ইটবাড়িয়া গ্রামের শ্রমজীবী নেছারউদ্দিন হাওলাদারের দুই ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মোসা. মারিয়া সবার ছোট। ইটবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এ ছাত্রীর শিক্ষা ও সংসার খরচ চলে স্কুল ও পড়াশোনার অবসরে মায়ের সঙ্গে নকশিকাঁথা সেলাই করে। ছোট্ট বয়সেই এখন সে নিপুণ কারিগর। সরেজমিনে রোববার দুপুরে মারিয়াদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকায় ঘরের বারান্দায় কাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত সে। তার সহপাঠীরা যখন ঘরের উঠানে গোল্লাছুট খেলা বা বাড়ির পুকুরে সাঁতার কেটে হাসি আনন্দে ব্যস্ত, তখন সে একমনে কাঁথায় এঁকে চলছে গ্রামীণ প্রকৃতি।
মারিয়া জানায়, মায়ের কাঁথা সেলাই করা দেখতে দেখতে ক্লাস ওয়ান-টুতে পড়া অবস্থায়ই সুঁই-সুতো নিয়ে গায়ের জামা, বিছানার চাদরে ফুল, ফল আঁকতাম। স্কুলে বিভিন্ন দিবসে নানা ধরনের ছবি আঁকতে আঁকতে শিখে ফেলেছি নকশিকাঁথা সেলাই। এখন স্কুল বন্ধ, তাই এই কাঁথা সেলাই করছি। মারিয়ার মা হালিমা বেগম জানান, রান্না থেকে শুরু করে গৃহের সব কাজই শিখে ফেলেছে সে (মারিয়া)। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে, স্কুলের ছুটিতে ঘরে বসে সেলাই করে এই কাঁথা। বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন আসে কাঁথা সেলাইয়ের জন্য। কারো ইচ্ছে পাতলা কাঁথা, কারো ইচ্ছে মোটা কাঁথা। তবে নকশিকাঁথা সেলাই হয় খুবই কম। কেননা একেকটি কাঁথা সেলাই করতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগে যায়। তিনি জানান, তার বড় ছেলে শামিম এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। ছোট ছেলে হাসান অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। মারিয়া চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। কিন্তু ওদের বাবা কখনো খালে মাছ ধরে, কখনো মাটি কাটে। মাঝেমধ্যেই কাজ না থাকলে ঘরে বেকার বসে থাকে। দরিদ্রতার মধ্যে তিন সন্তানকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য পরিবারে একটু আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে চার বছর ধরে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করছেন। পাতলা কাঁথা হলে মাসে আট থেকে দশটি, মোটা কাঁথা হলে দুই-তিনটি ও নকশিকাঁথা হলে একটির বেশি সেলাই করা যায় না। মারিয়া একটু বড় হওয়ার পর এখন নকশিকাঁথার আল্পনাও সে আঁকে। বয়স হয়ে গেছে। রাতে ঠিকমতো চোখেও দেখেন না। সুঁই গাঁথতেও কষ্ট হয়। তাই নকশাকাঁথা মারিয়াই বেশি সেলাই করে। বয়সে ছোট হলেও মারিয়া এই বয়সে জেনে গেছে বিভিন্ন ধরনের কাঁথার নাম। মারিয়ার ভাষায়, চলমান সেলাই (সাদামাটা কাঁথা), লহরী কাঁথা, আনারসি কাঁথা, বাঁকা সেলাই কাঁথা, সুজনি কাঁথা, পদ্ম নকশা, সূর্য নকশা, চন্দ্র নকশা, চাকা নকশা, স্বস্তিকা নকশা কাঁথা সেলাই করতে পারি। এ ছাড়াও গুজনি কাঁথা, রুমাল কাঁথা, আসন কাঁথা, আর্শিলতা কাঁথা সেলাই শিখেছে সে। কিন্তু সময় হয় না এগুলো সেলাই করার। তা ছাড়া এই কাঁথা তৈরি করতে খরচও অনেক বেশি পড়ে।
মারিয়া জানায়, লেখাপড়া করে বড় চাকরি করা ও ছবি আঁকার শিল্পী হওয়ার ইচ্ছা। কিন্তু পারিবারিক দৈন্যে কতটা লেখাপড়া করতে পারবে এ দুশ্চিন্তা এই বয়সেই তাকে ঘিরে রেখেছে। ক্লাসে মেধাবী ছাত্রী হলেও বইয়ের শিক্ষার চেয়ে তার এখন বেশি সময় কাটে সুঁই সুতোর বন্ধনে নকশিকাঁথায় চিত্র ফুটিয়ে তুলতে।





