জাতীয় সংসদে উত্থাপিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিল নিয়ে আজ মঙ্গলবার সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিল, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) এবং বেসরকারি টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোর সঙ্গে আলোচনা করবে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংসদ সচিবালয়ে বেলা ১১টায় এই বৈঠক শুরু হবে। অবশ্য এই বৈঠক নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ যেসব জায়গা নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীদের উদ্বেগ রয়েছে, এর আগে তা আমলে নিয়েছে কমিটি। গত ২২ এপ্রিলের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা শেষে কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আইনটির বিষয়ে যেসব উদ্বেগ আছে সেগুলো বিবেচনা করা হবে। স্টেকহোল্ডারদের (সুবিধাভোগীদের) সঙ্গে বৈঠক করে বিলটির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি। একই বিকালে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে সংসদীয় কমিটিতে থাকা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বিএফইউজে নেতারা। তারা স্পিকারের কাছে ১০ দফা প্রস্তাবও দেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আজকের বৈঠকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হককেও বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে বিলটি চূড়ান্ত করে বাজেট অধিবেশনেই প্রতিবেদন উত্থাপন করতে চায় কমিটি। গত ৯ এপ্রিল বিলটি সংসদে তোলেন মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। পরে সেটি পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দিতে সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
গত ১৯ এপ্রিল প্রস্তাবিত আইনের বিতর্কিত ছয়টি ধারা সংশোধনের দাবি ‘যৌক্তিক’ মন্তব্য করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সামনেই আইনটি চূড়ান্ত করা হবে। একই দিন এডিটরস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে বলা হয়, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন)-এর ২১, ২৫, ২৮, ৩১, ৩২ ও ৪৩ ধারা সম্পর্কে তাদের আপত্তি রয়েছে। কাউন্সিল মনে করে, এই ছয়টি ধারা স্বাধীন সাংবাদিকতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। তবে আইনমন্ত্রী বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, এ আইন বরং স্বাধীন মত প্রকাশে সহায়ক হবে।
মন্ত্রিসভা গত ২৯ জানুয়ারি ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’-এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার পর থেকে কয়েকটি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং দেশের সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ও ইউনিয়ন। তারা আইনটির কঠোর ও বিতর্কিত কিছু ধারা বাদ দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। ২১, ২৫ ও ২৮ ধারা নিয়ে গত ২৫ মার্চ উদ্বেগ জানান ১১টি দেশের কূটনীতিক। এসব আমলে না নিয়ে মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পাওয়া খসড়াটি হুবহু বিল আকারে সংসদে তোলা হয়। এতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে গুপ্তচরবৃত্তি, ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট, মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রচারণার মতো বিভিন্ন অপরাধের সংজ্ঞা ও সাজা নির্ধারণ করা হয়েছে। শুধু দেশে নয়, দেশের বাইরে বসে কেউ এই আইনের অধীনে এমন অপরাধ করলে বিচার করার বিধান রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত ৩২ ধারায় মূলত ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনের ১৪টি ধারার অপরাধ অজামিনযোগ্য।
এর আগে ২০০৬ সালে বাংলাদেশে প্রথম আইসিটি আইন করা হয়। পরে ২০০৯ ও ২০১৩ সালে শাস্তি বাড়িয়ে আইন আরো কঠোর করা হয়। আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ হয়রানির শিকার হন।
আজকের বৈঠক সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আলী আর রাজি বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আমার ধারণা, এডিটরস কাউন্সিল বা গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের দাবি মেনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন হবে না। এখন যে ধরনের সরকার রয়েছে, তারা সব পর্দা তুলে দিতে পারবেন না। নির্বাচন সামনে রেখেই তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটা প্রস্তাব করেছে। নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী প্রচার-প্রচারণার লাগাম টেনে রাখা এর একটা উদ্দেশ্য হওয়া অস্বাভাবিক না। যদি তাই হয়, তাহলে কেন সরকার তার ভাবনা বা পরিকল্পনা বদলাতে যাবে? তারা তো কোনো চাপের সম্মুখীন হয়নি। সাংবাদিকতার এই শিক্ষক মনে করেন, শুধু সাংবাদিকদের জন্য তো আর আইনটা হচ্ছে না। হচ্ছে রাষ্ট্রের সব নাগরিকের জন্য। এককভাবে সাংবাদিকদের করা দাবি সরকার আমলে নেবে বলে মনে হয় না। এই সরকার জনমতকে খুব মূল্য দিয়েছে বা দিচ্ছে, এমনও না। তারপরও আমি বলব, এই আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সংবাদকর্মীদের কর্তব্য। কিন্তু আশাবাদী হওয়ার সুযোগ সীমিত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সেলিম রেজা নিউটন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, প্রণয়ন-প্রক্রিয়ার দিক থেকে আইনটি অনেক দূর এগিয়ে গেলেও সাংবাদিক প্রতিনিধিদের জন্য এই বৈঠক একটা বিরাট সুযোগ; একই সঙ্গে বিরাট চ্যালেঞ্জও। কারণ প্রস্তাবিত আইনের বিভিন্ন ধারা-উপধারা দেখলেই বোঝা যায়, এটি দমনমূলক আইন। সরকার মানুষের কথা বলার স্বাধীনতাকে নিরুৎসাহিত করতেই এ আইন করছে। নিউটনের মতে, সাংবাদিকরা আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়ার পরও যদি আইনটি মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য দমনমূলকই থেকে যায়, সেক্ষেত্রে সরকারকে এককভাবে আর দোষ দেওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে। সরকার তখন বলার চেষ্টা করবে যে, গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের মতামত নিয়েই তো আইনটা করা হয়েছে। তিনি বলেন, তখন আবার সাংবাদিকদের বলতে পারতে হবে, আমাদের মতামত উপেক্ষা করে আইনটিকে দমনমূলক আইন হিসেবে বহাল রেখেছে সরকার। আমরা এটা চাই না।