মুক্তমত

সম্পর্কগুলো মাতৃঐতিহ্যের শেকড়ে প্রোথিত

  • প্রকাশিত ২ নভেম্বর, ২০২০

জুবায়ের আহমেদ

 

 

আমরা বাঙালি জাতি। আমাদের আছে ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে বিশ্বের বুকে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠিত করার গৌরব। পৃথিবীর বুকে ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য প্রাণ দেওয়া একমাত্র জাতি আমরাই। ৫২ মানেই আমাদের অধিকার আদায়ের গৌরবান্বিত অধ্যায়। আমাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছেন রক্ত দিয়ে।

তাদের আত্মত্যাগের ফলে বাংলা এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ভাষা। ১৯৫২ থেকে ২০২০, এর মাঝে কেটেছে ৬৮ বছর। আর এই ৬৮ বছরের মধ্যেই বাঙালি জাতির মধ্যে ইংরেজি ভাষার প্রচলন এত বেশি হয়ে গেছে যে, ইংরেজি না জানাকে আজকাল মূর্খতার সঙ্গে তুলনা করছেন অনেকে। ইংরেজি বিদেশি ভাষা নয়, যেন আমাদের মাতৃভাষা, এমন অবস্থা চলছে এখন তরুণসমাজের মধ্যেও।

আমাদের শৈশবে আমরা মামাকে মামা ডেকেছি, মামু ডেকেছি। কাকাকে কাকু ডেকেছি, চাচা ডেকেছি। খালাকে খালাম্মা, ফুফুকে ফুফু-ফুফি ডেকেছি। দাদাকে দাদা, নানাকে নানা, নানিকে নানি, দাদিকে দাদি ডেকেছি। সনাতন সমাজেও তাদের রীতিমতো বাংলাতেই আত্মীয়স্বজনের সম্পর্ক অনুযায়ী সম্বোধন করা হতো। আপনজন কিংবা দূরের মানুষ, যাকে যেভাবে বাংলায় সম্বোধন করা দরকার, আমরা সেভাবেই ডেকেছি। সেভাবে ডাকার শিক্ষাই পেয়েছি পরিবার ও গুরুজনদের কাছ থেকে।

সময়ের বিবর্তনে দেশে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একই হারে শিক্ষিত বিবেক, নীতিবান মানুষ না বাড়লেও ইংরেজি চর্চা করা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক, যাদের অধিকাংশই আজকাল চাচা, মামা, ফুফা, খালু— এই সম্পর্কের সবাইকে ইংরেজিতে আংকেল ডাকে। আবার একইভাবে ফুফু, খালা, চাচি, মামি— এমন সম্পর্কের সবাইকে ইংরেজিতে আন্টি ডাকে। দাদা-নানাকে ডাকে গ্র্যান্ডপা, দাদি-নানিকে ডাকে গ্র্যান্ডমা। পরিবারের ঘনিষ্ঠজন কিংবা দূরের মানুষ সব সম্পর্ককেই ইংরেজিতে সম্বোধনের ফলে আংকেলটা আসলে কার কী হয় কিংবা আন্টিটা কার কী হয়, তা বোঝা যায় না। তারা কি রক্তসম্পর্কীয় চাচা, ফুফু, দাদা-দাদি, মামা-খালা, নানা-নানি কিছুই বোঝা যায় না। সম্পর্কগুলোর গভীরতাকে উড়িয়ে দিয়ে শুধুই আংকেল-আন্টি সম্বোধন করা হয়। তাতে মনে হয় কোথাকার কোন আংকেল-আন্টি যেন তারা।

বাসায় যদি নিজের ফুফুও বেড়াতে আসে, তাকে আন্টি বলে ডাকার কারণে অপরিচিত কোনো মানুষ বুঝতেও পারে না যে এই আন্টিটাই এই পরিবারের সন্তান; যিনি বিয়ের আগে এই পরিবারের মধ্যমণি ছিলেন, এটিই তার শেকড়। আন্টি বলে পরিচয় দেওয়ার কারণে তিনি কোথাকার আন্টি, কার কী হয়, কত প্রশ্নই না চলে আসতে পারে অপরিচিতজনের সামনে। অথচ তিনি আমার ফুফু বললেই চেনা যায় যায় তিনি কে। এভাবে প্রত্যেকটি সম্পর্ককে বাংলায় সম্বোধন করলে কতই না গভীরভাবে উপলব্ধি করা যায় মানুষটির সঙ্গে পরিবারের ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে।

ইংরেজিতে সম্বোধনটাকে যদি স্বাভাবিক ধরেও নিই, বিষয়টা আসলেই স্বাভাবিকের পর্যায়ে নেই বর্তমানে। আমাদের শৈশবে আমরা পাড়ার যে কোনো বড় ভাই, চাচা-গুরুজনদের সম্মান, শ্রদ্ধার চোখে দেখেছি। নিজেরা শত দুষ্টুমি করলেও তাদের সামনে পড়লেই তাদের সম্মানটুকু দিয়েছি, দিতে চেষ্টা করেছি। তাদের শাসন মাথা পেতে নিয়েছি, তাদের ধমকে তটস্থ হয়েছি, এই বুঝি বাবাকে বলে দেবে দুষ্টুমি বা মন্দ কাজের কথা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি পুরোটাই ভিন্ন। আংকেল-আন্টি ডাকা প্রজন্ম ভুলে গেছে গুরুজনদের সম্মান করতে। কীসের পাড়াতো চাচা-বড় ভাই, তাদের যেন গোনার টাইমই নাই। ঘরের মানুষই তো এই প্রজন্মের অনেকের কাছে তুচ্ছ, সেখানে পাড়ার বড়-গুরুজন আবার কে? পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়ে জীবনযাপনেও পরিবর্তন আনা প্রজন্ম ইংরেজি চর্চার আড়ালে সামাজিক মূল্যবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্ককে ঠুনকো করে ফেলছে অনায়াসে।

বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী হিসেবে আমাদের ঐতিহ্য আছে, গৌরব আছে। আমরা কিছুতেই অন্য দেশের ভাষা কিংবা সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে তো নয়ই, অনিচ্ছায়ও বাংলাকে ছোট করতে পারি না, ছোট হবে এমন কোনো কাজ করতে পারি না, করা কাম্য নয়। অফিস-আদালত কিংবা বিদেশে যোগাযোগের বেলায় কিংবা ধর্মীয় সংস্কৃতির চর্চার লক্ষ্যে অন্য ভাষা শেখা আবশ্যক হলেও বাংলা ভাষার চর্চা করতে হবে প্রতি মুহূর্তে, প্রতিনিয়ত।

সেইসঙ্গে পারিবারিক সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করতে এবং গভীরতা বোঝাতে কাকাকে কাকু-চাচা, মামাকে মামা-মামু, ফুফুকে ফুফু-ফুফি, খালাকে খালা-খালাম্মাই ডাকব, আংকেল-আন্টি নয়। এই সম্পর্কগুলো প্রোথিত মাতৃঐতিহ্যের শেকড়ে। রক্তে কেনা বাংলার ভাষার চর্চাটা আমাদের পরিবারসহ সব ক্ষেত্রে সব বিষয়ে করা জরুরি।

 

লেখক :  শিক্ষার্থী, ডিপ্লোমা ইন জার্নালিজম

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব জার্নালিজম অ্যান্ড ইলেকট্রনিক মিডিয়া (বিজেম)

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads