ঐতিহাসিক শ্রমিক দিবস পহেলা মে। শত বছর আগে শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে পুঁজিবাদদের হাতে নিষ্পেষিত ও নিপীড়িত হতো অহরহ। মালিকদের সেই জুলুম নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলন দমন করতে শত শত নিরীহ শ্রমিক নিহত হয়। এরপর থেকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পহেলা মে শ্রমিক দিবস। পহেলা মে আসলে দেখা যায় লাল পতাকা আর মিছিল মিটিং। অথচ শ্রমিকরা আজও হীন তুচ্ছতাচ্ছিল্য। পুঁজিবাজারে তারা ধনীদের ওপরে উঠার মাধ্যম। আর ইসলাম দিয়েছে শ্রমিকদের যথাযথ সম্মান। মালিকদেরকেও শুনিয়েছে আদল ইনসাফভিত্তিক বাণী। ইসলামে যে ব্যক্তি স্বাবলম্বীতার পরিচয় দেয়, এমন শ্রমিক ও শ্রমজীবী আল্লাহর প্রিয়। বায়হাকী শরিফের হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ‘শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু’। আল্লাহ নিজে এদের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘এমন বহু লোক আছে যারা জমিনের দিকে দিকে ভ্রমণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) খুঁজে বেড়ায়।’ (সুরা মুযযাম্মিল, আয়াত-২০)
শ্রমিকের অধিকার : শ্রমিকের অধিকারকে আমরা মালিকের কর্তব্য ও দায়িত্ব বলে ব্যক্ত করতে পারি। মালিক এই দায়িত্বপালন করে না বলেই অহরহ শ্রমিক-বিক্ষোভ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। ইসলাম মালিককে এ ব্যাপারে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা দিয়েছে
এক : নিয়োগের আগেই শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। যাতে শ্রমিক না ঠকে এবং মালিককে ঝামেলার মুখোমুখি হতে না হয়। হাদিসের ভাষায় ‘মজুরের মজুরি নির্ধারণ না করে তাকে কাজে নিযুক্ত করবে না।’ (বায়হাকী)
দুই : শ্রমিককে মানবিক জীবনযাপনের উপযোগী ন্যায্য মজুরি পারিশ্রমিক দিতে হবে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ বলেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন রকমের লোকের বিরুদ্ধে লড়াই করব, যাদের মধ্যে এক রকমের লোক হলো তারা যারা শ্রমিকের কাছে থেকে পূর্ণ কাজ নিয়ে নিয়েছে অথচ তাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেয়নি।’ (বুখারি ৪/২০৮৩)
তিন: যথাসময়ে শ্রমিকের পাওনা মিটিয়ে দিতে হবে। নবীজির ভাষায় ‘ঘাম শুকানোর আগেই শ্রমিকের পাওনা মিটিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ)
চার : শ্রমিককে অযথা কষ্ট দেওয়া যাবে না। তার ওপর বাড়তি বা দুঃসাধ্য কাজ চাপাবে না। কঠিন কাজ দিলে তাকে সাহায্য করবে। তার খাদ্য ও পোশাকের মানানসই অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আবু যার গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমার ও আমার এক শ্রমিকভাইয়ের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। তার মা ছিল অনারব। আমি তাকে তার মা তুলে গালি দিই। সে ভাই এবিষয়ে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে অভিযোগ করেন। এরপর আমি যখন রাসুলুল্লাহ (স.)-এর সাথে সাক্ষাত করলাম তখন তিনি বলেন, আবু যার, তুমি কি তাকে মা তুলে গালি দিয়েছ? তোমার মধ্যে এখনো জাহিলিয়্যাত (মূর্খতা, অন্ধকার) রয়েছে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, মানুষ কাউকে গালি দিলে তো তার মা-বাবা তুলবেই! তিনি বলেন, আবু যার, তোমার মধ্যে জাহিলিয়্যাত বিরাজমান! তারা তোমাদের চাকরবাকর-শ্রমিক বা দাসশ্রেণি তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন ও দায়িত্বাধীন করেছেন। কাজেই তোমরা যা খাও তা থেকে তাদেরকে খাওয়াবে এবং তোমরা যা পরিধান কর তা থেকে তাদেরকে পরিধান করাবে। তাদের পক্ষে কষ্টকর বা অসাধ্য কোনো দায়িত্ব তাদের ওপর চাপাবে না। যদি কোনো কষ্টসাধ্য দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত কর তবে তোমরা তা পালনে তাদেরকে সাহায্য করবে।’ (মুসলিম, ৩/১২৮২, ১২৮৩)
পাঁচ : শ্রমিকের ক্ষমারযোগ্য ত্রুটি ক্ষমার নজরে দেখতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অধীনস্থকে ক্ষমার ব্যাপারে তাগিদ করলে এক সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, আমি তাকে দৈনিক কত বার ক্ষমা করব? নবীজী বললেন, “প্রতিদিন ৭০ বার (বহুবার)।” (আবু দাউদ ৪/৩৪১)
ছয় : দান-সাদকা মানুষের বালা-মুসিবাত দূর করে, আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করে। সুতরাং সাধ্য থাকলে গরিব শ্রমিককে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দান করা উচিত। যাতে তার জীবন কিছুটা সুন্দর হয়। কিন্তু মানুষের আচরণ ঠিক উল্টো, যা আল্লাহর কাছে তিরস্কৃত হয়েছে এভাবে “আল্লাহ জীবনোপকরণে তোমাদের কাউকেও কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন। যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেওয়া হয়েছে তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে নিজেদের জীবনোপকরণ থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা এবিষয়ে তাদের সমান হয়ে যায়। তবে কি ওরা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করে?’
সাত : শ্রমিক ও অধীন যে কারুর ব্যাপারেই খুব বেশি হুঁশিয়ার থাকতে হবে। কারণ, অধীনস্থের সাথেই অসতর্ক আচরণ সংঘটিত হওয়ার আশংকা বেশি থাকে। নবীজীর ইন্তিকালের সময় অসহ্য কষ্টের মধ্যেও দু’টি জিনিসের ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে গেছেন। একটি সালাত, অন্যটি অধীন। নবীজীর ভাষায় “সাবধান! সালাত এবং অধীনস্থের ব্যাপারে সাবধান!’ (ইবনে মাজাহ ১/৫১৯)
মুহাম্মদ মিজানুর রহমান
লেখক: প্রাবন্ধিক





