রাজনীতি

শুদ্ধি অভিযানেও বিতর্কে জড়াচ্ছে আ.লীগের অঙ্গসংগঠনগুলো

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

একদিকে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতে চলছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান; অন্যদিকে মূল দলের আসন্ন কেন্দ্রীয় সম্মেলনের অংশ হিসেবে চারটি সংগঠনের সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে। দলীয় শুদ্ধি অভিযানের মধ্যেই তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনের। ইতোমধ্যে সহযোগী সংগঠনগুলোর একাধিক নেতাকে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে অভিযানের মধ্য দিয়ে অভিযুক্ত ও কলুষিত নেতাদের ছেঁটে ফেলে সম্মেলনের মাধ্যমে সংগঠনগুলোতে নতুন ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের দায়িত্ব দেওয়ার কর্মযজ্ঞের মধ্যেও নানা বিতর্কে জড়াচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ও সহযোগী সংগঠনগুলো। ক্ষমতার অপব্যবহার থামছে না নেতাকর্মীদের।

ক্যাসিনো বাণিজ্যে জড়িত থাকা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও পদবাণিজ্যসহ সুনির্দিষ্ট নানা অভিযোগে সহযোগী সংগঠনের নেতারা গ্রেপ্তার হলেও সংগঠনেরই অন্য নেতারা অভিযুক্তদের পক্ষে বিবৃতি ও বক্তব্য দিচ্ছেন। নানা বিতর্ক ওঠা ও শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগেও সংগঠন থেকে বহিষ্কার করতে টালবাহানার কৌশল নিচ্ছেন শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ।

সূত্রমতে, সরকারি দলের সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ও সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি করছেন যারা, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তারের পাশাপাশি দল এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে দুভাবে আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দলীয় অভিযান চলতে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে বিতর্কিত, চাঁদাবাজ, অভিযুক্ত ও নানাভাবে অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত নেতাকর্মীদের সরিয়ে দিয়ে সংগঠনকে ‘বিতর্কমুক্ত’ করা যাবে বলে মনে করছে ক্ষমতাসীন দল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গড়া ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া এ দলের নেতৃত্বের সরকার আগামী ২০২০ সালে তার জন্মশতবর্ষ ও ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করবে। এর আগেই দল ও সহযোগী সংগঠনগুলোকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ সভাপতির কঠোর নির্দেশে দলের ভ্রাতৃপ্রতিম, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে ‘শুদ্ধ অভিযান’ চলছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমাদের নেত্রী (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) কী কঠোর, শুদ্ধি অভিযানে তা তিনি প্রমাণ করেছেন। দীর্ঘদিন পর একটি শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। কারো স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চলা শুদ্ধি অভিযান সারা দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার সৎ সাহস আছে।’

সূত্র জানায়, চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যেই আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন কৃষক লীগের সম্মেলনের জন্য রেলওয়ের কাছে ৩৮০টি ফ্রি টিকেটের আবদার করেছেন সংগঠনটির নেতারা। এ নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক লীগের জাতীয় সম্মেলন হবে আগামী ৬ নভেম্বর ঢাকায়। সেই সম্মেলনে যোগ দিতে আসবেন চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ১৯০ জন নেতাকর্মী। সেজন্যে তারা রেলওয়েকে ‘অনুরোধ’ করেছেন তাদের যেন বিনামূল্যে ৩৮০টি টিকেট দেওয়া হয়। কৃষক লীগের চট্টগ্রাম উত্তর জেলা কমিটির পক্ষ থেকে এ নিয়ে রেলওয়ের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের যাওয়া-আসার জন্য রেলওয়ের কাছে তূর্ণা-নিশীথা এক্সপ্রেসের চট্টগ্রাম-ঢাকা-চট্টগ্রামের প্রথম শ্রেণির ফ্রি টিকেট চেয়েছে সংগঠনটি। তূর্ণা নিশীথা ট্রেনের প্রথম শ্রেণির প্রতিটি টিকেটের দাম ৭৩৫ টাকা আর ৩৮০টি টিকেটের দাম আসে ২ লাখ ৭৯ হাজার ৩০০ টাকা। কৃষক লীগের এমন আবেদনে অনেকটাই ‘বিব্রত’ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

কৃষক লীগের একাধিক সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের মূল কমিটিতে যারা ঠাঁই পান না, ঢাকা মহানগরে তাদের সন্তুষ্ট রাখতে সহযোগী সংগঠনগুলোতে পদ দেওয়া হয়। এতে তারা একটা রাজনৈতিক পরিচয় পান। আর এসব পদ ব্যবহার করে অনেকে নানা রকম স্বার্থ হাসিল, ধান্ধা ও তদবির করছেন। শূন্য থেকে অনেকে কোটিপতি হয়েছেন। পদবাণিজ্যে কৃষক লীগের কয়েক নেতাও দলের অন্য সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতাদের সমান এগিয়ে আছেন।

গত ২০ সেপ্টেম্বর কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ঢাকার কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের চেয়ারম্যান শফিকুল আলম ফিরোজকে ক্লাব থেকে অস্ত্র-গুলি, ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব। এরপর তাকে কৃষক লীগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরকম অপকর্মে জড়িত আছেন আরো কয়েকজন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, মন্ত্রী ও এমপিদের দপ্তরে তদবির, টেন্ডার, চাঁদাবাজি, অবৈধ ক্যাসিনোর পৃষ্ঠপোষকতাসহ নানা অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। সংগঠনটির ২০১২ সালের ১৯ জুলাই সবশেষ কেন্দ্রীয় সম্মেলন সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমান কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে ২০১৫ সালের জুলাইয়ে। এরপর প্রায় চার বছর ধরে সম্মেলন না হওয়ায় বর্তমান কমিটি দিয়েই চলছে কৃষক লীগের কার্যক্রম। এবার সম্মেলন হতে যাওয়ায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্যও আছে।

অন্যদিকে গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক সভায় চাঁদা দাবির অভিযোগে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রব্বানীকে অপসারণের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। পাশাপাশি যুবলীগ নেতাদের বিষয়েও চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এরপর থেকে অভিযান শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) একটি বাজার ইজারা নেওয়ার জন্য দরপত্রে অংশ নিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন ছাত্রলীগের বংশাল থানার সভাপতি ইমরান হোসেন জন। সংগঠনের নেতারা বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের কোনো নেতা দরপত্রে অংশ নিতে পারেন না। গত ১ অক্টোবর থেকে টোল আদায়ও শুরু করেছেন ইমরান হোসেনের লোকজন। এ নিয়েও বিতর্কের কবলে পড়েছে ছাত্রলীগ।

সূত্র জানায়, ঢাকায় ক্যাসিনো-কাণ্ডে ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার অভিযোগে সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমের শিরোনাম হন আওয়ামী লীগের আরেক সহযোগী সংগঠন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদ থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মোল্লা মো. আবু কাওছার। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অভিযান চালিয়ে মদ, নগদ টাকা ও ক্যাসিনোর সরঞ্জাম জব্দ করে র্যাব। কাওছার ছিলেন ওই ক্লাবের সভাপতি। অভিযানে ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের মালিকানা হিসেবেও তার নাম উঠে আসে। তবে সভাপতি হলেও মালিকানার অভিযোগটি অস্বীকার করে বিবৃতি দেয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক ও সংসদ সদস্য পংকজ নাথেরও স্বাক্ষর ছিল ওই বিবৃতিতে। অভিযোগ ওঠে, মোল্লা কাওছারকে রক্ষায় কৌশল করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কয়েক নেতা।

অবশ্য ক্যাসিনো ব্যবসার অভিযোগে স্বেচ্ছাসেবক লীগের পদ থেকে মোল্লা কাওছারকে গত বুধবার অব্যাহতির একদিন পরই সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথকে সংগঠনের আসন্ন সম্মেলনের কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশের খবরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ নাথকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আগামী সম্মেলনের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। দলীয় সভাপতির এ নির্দেশ এরই মধ্যে পংকজ নাথকে জানিয়ে দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।’

সভাপতিকে অব্যাহতির পর সাধারণ সম্পাদককেও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সম্মেলনের সামগ্রিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন তৃণমূলের কর্মীরা। বিশৃঙ্খলা এড়াতেই তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। স্বেচ্ছাসেবক লীগের নতুন আহ্বায়ক কমিটিও গঠন করা হয়েছে। সংগঠনটির তৃতীয় কেন্দ্রীয় সম্মেলন আগামী ১৬ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হওয়ার কথা রয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads