শীত চলে যায় শীতের পিঠার ভাপে

শীত চলে যায় শীতের পিঠার ভাপে

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

শীত চলে যায় শীতের পিঠার ভাপে

  • এসএম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৩ জানুয়ারি, ২০১৯

এই শীতে গরম গরম পিঠা খেয়েছেন কী? ভাপা, চিতই, পাটিশাপটা? কাব্য করে বলা যায়, শীতে যখন শক্ত বাহু কাঁপে/শীত চলে যায়, শীতের পিঠার ভাপে। এখন শীতকাল। ষড়ঋতুর অন্যতম ঋতু শীত মানেই পিঠা-পায়েসের মৌসুম। বাঙালিয়ানা কৃষ্টির অংশ হিসেবে শীত ঋতুর সঙ্গে পিঠাপুলির সম্পর্কটি যেন নাড়ির টানে বাঁধা। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় দেড়শ রকমের পিঠা তৈরি হয়। একেক পিঠা তৈরির উপাদান একেক রকম। অঞ্চলভেদেও আছে পিঠা তৈরির রীতি-রেওয়াজের ভিন্নতা। শীতকালে বিশেষত গ্রামে পিঠাপুলি, ক্ষির-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। আঙিনায় মাটির চুলায় পিঠা বানানোর মনকাড়া দৃশ্য গ্রামীণ ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়। মায়ের হাতের পিঠা, বোনের হাতের পুলি অথবা পায়েস আমাদের হূদয়ে দুরন্ত শৈশবকে জাগিয়ে তোলে। এজন্য হয়তোবা কবি বেগম সুফিয়া কামাল ‘পল্লী মায়ের কোল’ কবিতায় পিঠা নিয়ে লিখেছেন- ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশীতে বিষম খেয়ে/আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।’ কবির কথায় পিঠা তৈরি করা আর পিঠা খাওয়ার আয়োজনকে কেন্দ্র  করে আমাদের বাঁধভাঙা দুরন্ত শৈশবের স্মৃতিকথাই বেশি মনে পড়ে। আহারে শীতের পিঠার কত বাহারি নাম- মালপুয়া, লালপুয়া, জামাই পিঠা, পাতা পিঠা, পাকান পিঠা, চিতই পিঠা, ভাপা পিঠা, পাটিসাপটা, ফুল পিঠা, দুধ পিঠা, নারকেলের তিলপুলি, বকুল পিঠা, তেল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, বিবিখানা পিঠা, সাজ পিঠা, দুধচিতই, পাটা পিঠা, মুঠা পিঠা, নকশি পিঠা, দুধপুলি, চষি পিঠা, ঝাল পিঠা, মালাই পিঠা, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, ক্ষীরকুলি, দুধে ভেজানো হাতকুলি, ঝিনুক পিঠা, ম্যারা পিঠা, ছিটা পিঠা আরো কত কী।

লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, শীতে মহানগরের অলিতে-গলিতে বসে পিঠার দোকান। এসব দোকানে চিতই, ভাপা পিঠার তুমুল জনপ্রিয়তা। সঙ্গে আছে পাটিসাপটা, তেলের পিঠা, নকশি পিঠাসহ হরেক রকমের পিঠার আয়োজন। বলা যায়, শীতে বাঙালির ঐতিহ্যের খাবারের মধ্যে চিতই পিঠা অন্যতম। চুলা থেকে সদ্য নামানো গরম গরম ধোঁয়া ওঠা চিতই পিঠার স্বাদ অসাধারণ। শীতে সব জায়গাতেই ভাপা ও চিতই পিঠা পাওয়া গেলেও রসের পিঠা গ্রাম ছাড়া পাওয়ার খুব একটা সম্ভাবনা নেই। খেজুরের রসের সঙ্গে দুধ আর নারকেল দিয়ে রসের পিঠার অবর্ণনীয় স্বাদ পেতে গ্রামে যেতে হবে। অবাক করা ভালো দিকটি হলো- গ্রামীণ এসব পিঠা শহরে কেবল গ্রামের ঐতিহ্যের জানান দিচ্ছে তাই নয়, এই পিঠাকে কেন্দ্র করে মৌসুমি বিরাট বাণিজ্যও হচ্ছে। কোনো পরিসংখ্যান ছাড়াই বলা যেতে পারে গ্রামীণ পিঠাও এখন অর্থকরি শিল্পের পথে হাঁটছে। উল্লেখ করা যেতে পারে চিতই পিঠার কথা। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী সেই চিতই পিঠা শহরে এখন কেবল শীতকালে নয়, সারা বছরই সমান জনপ্রিয়। বিশেষত শীতে শহরের পাড়া-মহল্লায় চিতই আর ভাপা পিঠার জমজমাট ব্যবসা হয়। এই পিঠা তৈরিকে কেন্দ্র করে অনেক মানুষের জীবিকা নির্বাহের উপায় হচ্ছে। কারণ শহরের মানুষের সময় নেই। তাছাড়া পিঠা তৈরি করা অনেক ঝামেলার কাজ। আর এ সুবাদে শহরের মানুষ গ্রামীণ পিঠা খাওয়ার স্বাদ দিতে দোকানে ভিড় করে।

বাঙালির জাতীয় জীবনে বারো মাসের ষড়ঋতুতে পৃথক পৃথক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বাংলাদেশে ছয়টি ঋতুর অন্যতম প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যনির্ভর ঋতুর নাম শীত। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস শীতকাল। শীতের সকালে আয়েশ করে পিঠা-পায়েস খাওয়ার রীতি গ্রামবাংলার চিরায়ত সভ্যতার ধারাবাহিকতা। শীতের আগের ঋতুটি হেমন্ত। হেমন্তকালে গ্রামবাংলায় নতুন ফসল ঘরে উঠেছে। এরপরই শীতের আগমনে গ্রামবাংলার হাজার বছরের কৃষ্টি পিঠা-পায়েসের উৎসব শুরু হয়। পিঠা ছাড়া শীতকালে বাঙালির আতিথেয়তাও যেন সম্পূর্ণ হয় না। তাই শীত এলেই বাঙালির পারিবারিক রীতি অনুযায়ী মেয়ে-জামাতাকে দাওয়াত করে আনা হয়। এ সময় পারিবারিক আত্মীয়সহ পরিবারের যারা শহরে থাকেন তাদের সবাই বাড়ি যেতে চেষ্টা করেন। উপলক্ষ শীতের পিঠা-পায়েসের স্বাদ নেওয়া।  কেননা, শীত মৌসুমে গ্রামে গিয়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে পিঠা-পায়েসের স্বাদ নেওয়ার মাঝে যে পরিতৃপ্তি পাওয়া যায় তা আর কিছুতে পাওয়া সম্ভব নয়। যদিও এখন যান্ত্রিক ব্যস্ততার যুগে পরিবারের সবাই মিলে গ্রামবাংলার  সেই রসালো পিঠা-পায়েস খাওয়ার উৎসব-রীতি অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে। তবুও এখন শহুরে নাগরিক জীবনে গ্রামীণ আবহ পেতে গ্রামীণ পিঠাপুলির বর্ণিল বাহারি আয়োজনে পিঠা উৎসব যেন গ্রামীণ ঐতিহ্যের ভিন্নমাত্রায় রূপান্তর ঘটেছে। এসব পিঠা উৎসব প্রকারান্তরে গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী পিঠাপুলির শৈল্পিকতাকে প্রজন্মান্তরে বিকশিত করার একটি বড় মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখছে। প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক ডিজিটাল জমানায় শহুরে নাগরিক জীবনের সূতিকাগার হিসেবে গ্রামের অস্তিত্বকেই জানান দিচ্ছে পিঠা উৎসব। 

পৌষ মাস শুরু হলেই বিভিন্ন সংগঠনের পিঠা উৎসবের তোড়জোড় দেখা যায়। এর পেছনে বাণিজ্যিক বিষয় যেমন রয়েছে, তেমনি সাংস্কৃতিক বিকাশের ব্যাপারটিও গুরুত্বপূর্ণ। তবে পিঠা উৎসবের নামে শহরে যত ডামাডোল পেটানোই হোক না কেন, শীতের পিঠার আদি ঐতিহ্য বা গোড়াপত্তন কিন্তু গ্রামেই। আশার ব্যাপারটি হচ্ছে সময়ের বিবর্তনে গ্রামীণ অনেক পিঠা আধুনিক সংস্করণের নতুন মাত্রা পাওয়ার সুবাদে বাণিজ্যিকীকরণের পরিধিও ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। আরো ভালো খবর হলো- বাঙালির পিঠা এখন দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বের প্রায় ৮০টি  দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। পিঠাপুলির সঙ্গে বাঙালির এই মিলনমেলা প্রাগৈতিহাসিক। এখন সবই যান্ত্রিকতার মোড়কে মিশে গেলেও তা যেন হারিয়ে না যায় সেক্ষেত্রে শহরের পিঠা উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পিঠার প্রতি বাঙালির ঐতিহ্য ও আবেগকে কেন্দ্র করেই পিঠাবাণিজ্যের আবির্ভাব ঘটছে শহরের নাগরিক জীবনে। একইভাবে প্রবাসি বাঙালিদেরকে কেন্দ্র করে বিদেশে পিঠা বাজারজাতকরণের মাধ্যমে আমরা বিপুল মুদ্রা অর্জন করতে পারি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads