ফিচার

শিল্পী অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খানের গ্রামের ইতি কথা (পর্ব তিন)

  • প্রকাশিত ২৫ জুলাই, ২০২১

ভাস্কর শিল্পী আইভি জামান

 

সহশ্রাম কটিয়াদি উপজেলার একটি গ্রাম। উনিশ-শ একান্ন  সালের কটিয়াদি উপজেলার জনসংখ্যা খুবই কম ছিল। জনসংখ্যা দুই লাখ বিরাশি হাজার দুই শত সাতানব্বই জন। সেই অনুপাতে সহশ্রামে জনসংখ্যা কমছিল। প্রথমত এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক সমাজ। অধিকাংশই দরিদ্র, পরে অবশ্য বেশ কিছু মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজনের আগমন ঘটে। তবে উচ্চ বিত্তের সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল। কটিয়াদি উপজেলার মশুয়া একটি গ্রাম। উপজেলার সদর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে ছায়াঘেরা ছোট গ্রামে যেয়ে দেখতে পেলাম সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে  আছে। সেই সবুজের মাঝে লাল রঙের ইটের পুরাতন ব্রিটিশ আমলের তৈরি সত্যি জিৎ রায়ের  পৈতৃক নিবাস। ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ‘রায় পরিবার’ আমাদের গর্ব। পরিবারের উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও সুকুমার রায় তাঁদের সাহিত্যকর্ম দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন শিশুসাহিত্যক, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ছোটদের জন্য পৌরাণিক কাহিনী ও উপকথা লিখতেন। তাছাড়া তিনি পাশ্চাত্যে নিয়মে তেল রং ও জল রং এবং কালিকলমে ছবি আঁকতেন। এই গুণী ব্যক্তিত্বের জীবনাবসান হয় উনিশ-শ পনেরো সালে কুড়ি ডিসেম্বর।

তাঁর কৃতী পুত্র সুকুমার রায়ের জন্ম আঠারো-শ সাতাশি সালে। জন্মেছিলেন সুকুমার রায় বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক। তিনি কবিতা, নাটক, গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁরই পুত্র সত্যজিৎ রায় ছিলেন অস্কার বিজয়ী প্রয়াত চলচ্চিত্রকার এবং সাহিত্যিক। পুকুর পাড়ে এখনো শান বাঁধানো ঘাট। সেই ঘাটে বসে সাধারণ মানুষ তাদের পূর্বপুরুষের ভিটার মানুষদের কথা গল্প করছেন। তখন আমি খুব আনদ পেলাম। উনিশ-শ পঁয়তাল্লিশে জন্ম বালক হামিদুজ্জামান ভাটি অঞ্চলের। বৃষ্টির শব্দে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করে খেলার মাঠে  দৌড়ঝাঁপ করে বেড়ে ওঠেন । টানা বৃষ্টি হলে চলাফেরা সহজ ছিল না। গ্রামে তখন খুঁটিওয়ালা খড়মের প্রচলন ছিল। খড়ম পায়ে হেঁটে কাদার মধ্যে ভিজে চলতে হতো। সন্ধ্যা হলেই নিঝুম ঘুটঘুটে অন্ধকার । কেরোসিন ও কুপিবাতি ছাড়া অন্য কোনো আলোর ব্যবস্থা ছিল না। বর্ষাকালে হামিদুজ্জামানের বাড়ির  পেছনে উন্মুক্ত খোলা বিল পানিতে পুকুরসহ ডুবে যেত। গ্রামে সপ্তাহে নির্দিষ্ট দিনে হাট বসত। হামিদুজ্জামান বাবার সাথে হাটে যেতেন। গ্রামের হাটের রূপ দেখে অবাক হতেন। সন্ধ্যা হলেই হাটের রূপ পাল্টে যেত। বড়ো সাইজের কেরোসিনের কুপিবাতি জেলে উঠত। ভিন্ন এক স্মৃতি। হাট থেকে বাল্যশিক্ষা কিনে বাবার আগ্রহে পড়াশোনা শুরু করেন। মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন গৃহিণী। রুচিবান, দরদি। দশ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহশ্রাম গ্রামে আসেন। কটিয়াদি উপজেলাসংলগ্ন এলাকায় চরপারার মেয়ে। বর্ষাকালে আষার শ্রাবণ মাসেই যে কোনো সময় হামিদুজ্জামানের মা চরপারা বেড়াতে যেতেন। সঙ্গে হামিদুজ্জামান যেত। বাহন ছিল ছইওয়ালা নৌকা। নৌকার সামনে চাদর দিয়ে ঢাকা থাকত। দূরত্ব ছিল প্রায় সাত-আট কিলোমিটার। যাওয়ার সময় খাল-বিল-নদী-নালা পেরিয়েই যেতে হতো। সময় লাগত প্রায় সারা দিন। শিল্পমনা হামিদুজ্জামান বৃষ্টির পানি ফোটা শাপলা দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যেতো। তখন ভেসে থাকা ধান গাছের কচিপাতা, কখনো   শাপলা ফুল তোলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যেতো। পানি ফল, ফোটা শাপলা ফুল তোলা নিয়ে অস্থির হতো। মা রাবেয়া খাতুনের যেন  সন্তানের প্রতি ছিল অবাধ স্বাধীনতা। চরপাড়া গ্রামে মায়ের সাথে আত্মীয়স্বজনের হাতে নকশি পিঠা খাওয়া-দাওয়া ও পাড়া বেড়ানোর সুযোগ পায় হামিদুজ্জামান। অজান্তেই অজপাড়া গাঁয়ের প্রকৃতির সাথে মিশে যেতেন। তখন হামিদুজ্জামানের চোখে পড়ে ফসল ঘরে রাখার নানা কৌশল। একদিন তার মামা কটিয়াদি উপজেলার গ্রামের হাট দেখাতে হামিদুজ্জামানকে নিয়ে যান। সেখানে হাট থেকে শোল মাছ কিনে হামিদুজ্জামানের হাতে দেন। পায়ে  হাঁটার পথ ঘুটঘুটে অন্ধকার হাতে হারিকেন। মাঝপথে থেমে দেখে মাছটি উধাও হয়ে গেছে। হামিদুজ্জামান ভয়ে অস্থির, কারণ মাছটি হামিদুজ্জামান এর হাতেই ছিল। মামা বললেন এরকম এখানে মাঝে মাঝে হয়।

মাছটি জিন নিয়ে গেছে। হামিদুজ্জামানের জন্ম একতালা পুরাতন দালানে। বাবা হাজী ডাক্তার ছায়মউদ্দিন খান হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার। অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি, গচিহাটা বাজারের মালিক, ডাক্তার সাহেব বলেই সবাই সম্মান করে। বাজারের নিজ জায়গায় তাঁর ডাক্তারখানা ছিল। তিন সন্তানের জনক ছিলেন। বড় ছেলে আখতারুজ্জামান পেশায় কৃষিজীবী। মেজো ছেলে ছৈয়ুদুজ্জামান  গচিহাটা বাজারে ব্যবসা করতেন। হামিদুজ্জামান বাবার আদরের ছোট ছেলে। উনিশ-শ একান্ন সালে হামিদুজ্জামানকে নিয়ে বাবা বাড়ির পাশে একটি সহশ্রাম প্রি-প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করান। বাড়ির সামনে সমতল সবুজ ধানক্ষেত। রেললাইনের পাশ ঘেঁষে খেলার মাঠ, পাশেই স্কুল।  শিক্ষকরা সময় মতো স্কুলে আসতেন। ছাত্ররা মাঠে খেলতে থাকত, শিক্ষক সাইকেল চালিয়ে আসলেই ক্লাশ শুরু হতো।

একদিনের ঘটনা, স্কুল ইন্সপেক্টর স্কুল পরিদর্শনে আসেন। থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ইনসপেক্টর সাহেব ছাত্রদের নানা ধরনের প্রশ্ন করেন। একসময় হামিদুজ্জামানকে প্রশ্ন করেন হাতে পায়ে কতগুলো আঙুল? উত্তরে হামিদুজ্জামান বললেন বাইশটি। তখন ইনসপেক্টর সাহেব হামিদুজ্জামানকে কাছে ডাকলেন। হামিদুজ্জামান নির্ভয়ে কাছে এসে পায়ের আঙুল দেখিয়ে দিলেন, সবাই হতবাক, ক্লাশের সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পরবর্তীতে হামিদুজ্জামানের উচ্চমাধ্যমিকের স্কুল স্মৃতি। বনগ্রামে আনন্দ কিশোর হাইস্কুলে ভারতের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হেমেন্দ্র নাথ  মজুমদার তাঁর বাড়ি সহশ্রাম গ্রামের পাশেই গচিহাটা গ্রামে ও একই স্কুলে ছাত্র ছিলেন। বনগ্রামের প্রখ্যাত সাহিত্যক নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়ির বর্ণনা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads