রাশেদ ইসলাম
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্ব এক ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালের কেবিনে আছে এবং শিক্ষার্থীদের অবস্থা হাসপাতালে আইসিইউ’র রোগীর মতো। প্রায় ১৯ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। সেইসাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত ১৮ বার নেওয়া হয়েছিল। তবে তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি আরো দীর্ঘায়িত হলে বিকল্প কী, ততদিন কি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে? সরাসরি পাঠদান ও পরীক্ষার বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে? টানা ছুটিতে ২০২০ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এই তিনটি শিক্ষাবর্ষের সূচি সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন তছনছ। বড় ধরনের ক্ষতির দিকে শিক্ষাব্যবস্থা।
করোনার সংক্রমণের হার প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রেকর্ড হচ্ছে। তারপরও সরকার জনগণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সরকারি-বেসরকারি অফিসের পাশাপাশি গণপরিবহন ও মার্কেটগুলো খুলে দিয়েছে। সংক্রমণের হার না কমার পরও যখন সবকিছু খোলা, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাকি থাকবে কেন? শিক্ষার্থীরা না হয় ঘরে থাকে; কিন্তু তার পরিবাবের বাকি সদস্যরা তো হাটে-মাঠে-ঘাটে সর্বত্র চলাচল করছে। সেই জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো তোয়াক্কা নেই। ফলে শিক্ষার্থীরা ঘরে থাকলেও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। তাই বলে কি বছরের পর বছর ঘরেই থাকবে? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসরুমের তালা ঝুলে থাকবে! দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল করতে বা চালু করতে কখনো লকডাউন আবার কখনো শিথিলতা প্রদর্শন করা গেলে, শিক্ষার্থীদের ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতেও ধাপে ধাপে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্তে আসতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২ আগস্ট পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭২ হাজার ২৫৭ জন এবং চিকিৎসা শিক্ষার ৩ হাজার ৬৬২ জন শিক্ষার্থীকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিয়েছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধিকাংশ শিক্ষার্থী এখনো টিকার বাইরে আছেন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রায় ৯০ লাখ ডোজ (প্রায় ৪৫ লাখ শিক্ষার্থী) টিকা দেওয়া গেলে সবাইকে টিকার আওতায় আনা সম্ভব বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে জানানো হয়েছে। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা টিকা নিবন্ধন করে ঘরে বসে আছে, তারা জানে না কবে দেওয়া সম্ভব হবে? উচ্চ মাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক পর্যায় শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া অসম্ভব বলে কিছু নেই।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেছেন, আগস্ট মাসে কতসংখ্যক শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া যাবে এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হার কেমন থাকবে, তার ওপর নির্ভর করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়টি। তাহলে স্পষ্ট বোঝায় যাচ্ছে টিকা না দেওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে যেতে পারছে না। ফলে শিক্ষার্থীদের দ্রুত টিকা দেওয়া সময়ের দাবি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ১ম বর্ষের অনেক শিক্ষার্থীর বয়স কম থাকার কারণে জাতীয় পরিচয়পত্র নেই বা কলেজের কার্ড তাদের হাতে আসেনি। ফলে পরিচয়পত্র দিয়ে তাদের টিকার আওতায় আনতে হবে।
কিন্তু এই ক্ষতি পোষাতে দীর্ঘমেয়াদি সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে একটি শিক্ষাবর্ষের পুরোটাই হারিয়ে গেছে। আরো একটি শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে। তবুও মূল্যায়ন করে দেখাতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেল, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে দেশের স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত বছর ১৭ মার্চ থেকে ছুটি চলছে। আগামী কত দিনে খোলা হবে সে নিশ্চয়তা নেই। অবশ্য এ সংকট শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের গত মার্চে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ লকডাউনের কারণে বিশ্বব্যাপী ১৬ কোটি ৮০ লাখের বেশি শিশুর জন্য স্কুল প্রায় এক বছর ধরে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে, গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের মতো দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল বাংলাদেশ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকার কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে যাচ্ছে। পরীক্ষা নিয়ে দক্ষতা যাচাই না করে ওপরের ক্লাসে উঠে যাচ্ছে। গ্রামে ও বস্তি এলাকায় কিশোর গ্যাং তৈরি হচ্ছে ও কিশোরীরা বাল্যবিয়ের শিকার হচ্ছে। অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অনলাইনে গেমসগুলোতে আসক্ত হয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
করোনা পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে তা মেনে নিয়েই মানুষকে জীবনযাপন করতে হবে। তাই অনির্দিষ্ট সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ না রেখে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে কীভাবে সচল করা যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। একসঙ্গে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিয়ে প্রথমে এলাকাভিত্তিক এবং শ্রেণিভিত্তিক ক্লাসের ব্যবস্থা করতে হবে। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী উন্নত দেশগুলো তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত দেশের জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা বড়ই চ্যালেঞ্জিং। আর এই চ্যালেঞ্জকে বাস্তবতায় নিয়ে যেতে হলে অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে সমাধান করা জরুরি। বর্তমান ডিজিটালাইজেশনে যুগে মানুষের সহজপ্রাপ্যতা যোগাযোগের মাধ্যম ইন্টারনেট। ফলে অনলাইন হচ্ছে সুপার হাইওয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে করোনাকালীন অনলাইন প্ল্যাটফরম জুমে পরীক্ষা দেওয়ার সময় কেউ গাছে চড়ে, কেউ খড়ের পালা, আবার কেউ উঁচু ঢিবিতে উঠে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। শিক্ষার্থীদের এমন ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা দেখেছি। এই যোগাযোগ সরঞ্জামাদির আপডেট করে বহির্বিশ্বের সঙ্গে সমতালে শিক্ষাকার্যক্রম সচল রাখা এখন সময়ের দাবি। তা না হলে দেশ ‘হীরক রাজার দেশে’ পরিণত হতে পারে।
বর্তমানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। করোনাকালে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মধ্যে রাখতে, গত বছরের ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিক এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশন প্রচার করছে। এছাড়া রেডিও, অনলাইন ও মোবাইলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণস্বাক্ষরতা অভিযানের ‘এডুকেশন ওয়াচ ২০২০-২০২১’ সমীক্ষার অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে, গত জানুয়ারিতে বলা হয় দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল সাড়ে ৩১ শতাংশ। এছাড়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইনে ক্লাসই হয় না সেই চিত্র উঠে এসেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বছরের জন্য সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে ৬০ দিন ক্লাস করিয়ে এসএসসি এবং ৮০ দিন ক্লাস করিয়ে এইচএসসি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু সেটিও বাস্তবায়ন হবে কি না তা ঘোলাটে অবস্থায় আছে। তা ছাড়া লকডাউনে অসহায়, কর্মহীন ও হতদরিদ্র পরিবারে দারিদ্র্যের কারণে হুহু করে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমতাবস্থায় পরিবারের পক্ষে ডিজিটাল ডিভাইস ক্রয় করে ক্লাসে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়।
তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে শিক্ষকরা শিখন কার্যক্রম চালাবেন বলে আলোচনায় ছিল; কিন্তু সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। শুধু অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা নিজে না করে অন্যের দ্বারাও সমাধান করে নিচ্ছে। সন্তানদের শিক্ষক রেখে প্রাইভেট পড়ানোর আর্থিক সামর্থ্য তাদের নেই। অধিকাংশ পরিবারেই কোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন নেই। তাই অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ নেই তাদের। ফলে নিয়মিত পড়াশোনা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে না এবং অনেকেই ঝরে যাবে শিক্ষা থেকে। করোনার আগে ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৩৭.৬২ শতাংশ। ২০২১ সালে ঝরে পড়ার হার যে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যাবে।
শিক্ষার সংকট কাটাতে হলে, সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের টিকাদান নিশ্চিত করে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য ইংরেজি, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে ছুটির দিনে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা, গরিব পরিবারগুলোকে আর্থিক ও খাদ্য সহায়তা দিয়ে ড্রপআউট শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনতে হবে। অটোপাসের পরিবর্তে সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট সংকট নিরসন করা, বেসরকারি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি মওকুফ করা—এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এই ক্রান্তিলগ্নে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রকে শিক্ষা ধ্বংসের ভুলনীতি সিদ্ধান্ত বাতিল করে শিক্ষার সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক। তা না হলে মহান মুক্তিযুদ্ধে রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতার মূল্য অর্থহীন হয়ে যাবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জয়পুরহাট সরকারি কলেজ।