১২ ফেব্রুয়ারি থেকে লালমাটিয়ার দ্বীপ গ্যালারিতে শুরু হয়েছে কবি ও উদীয়মান চিত্রকর শামসেত তাবরেজীর একক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ‘র্যান্ডম ভিগনেটস’। কখনোই থিমেটিক জায়গা থেকে কাজ করেন না শামসেত তাবরেজী। কাজ যখন শুরু করেন তখন এটি একটি থিমের দিকে বা একটি গল্পের দিকে কিংবা একটি আচরণের দিকে যায়। তাবরেজী খুব দ্রুত কাজ করেন। মুভমেন্টটাকে ধরার চেষ্টা করেন, সেটা যতক্ষণই লাগুক। ছবিটি মুভমেন্ট করার মতো না হলেও তিনি মুভমেন্ট করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি চারপাশের বিষয়গুলো নিয়ে ছবিতে সংমিশ্রণ ঘটান।
কবির আঁকাআঁকি শুরু হয় ২০১৯ সাল থেকে। সেই বছর ‘মুহূর্তমা’ নামের এক প্রদর্শনীতে কবি শামসেত তাবরেজী দেখিয়েছিলেন তার রঙের কথামালা। সে চিত্রপ্রদর্শনীও হয়েছিল এই দ্বীপ গ্যালারিতে। মহামারী যখন শেষের পথে, তখন আবারো কবি ঘর থেকে বের করলেন আরও কিছু নতুন চিত্রকর্ম। সেগুলো কেবলই চিত্রকর্ম নয়, যেন ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিকের কবিতা। কিউরেটরের হাত ঘুরে গ্যালারির দেয়াল শোভিত ছিল ৫৭টি চিত্রকর্মে। শামসেত তাবরেজীর দ্বিতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন শিল্পী নিসার হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের চেয়ারপারসন শিল্পী রশিদ আমিন, শিল্পী দিলারা বেগম জলি, ঢালি আল মামুন, ওয়াকিলুর রহমান, প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কবি সাজ্জাদ শরিফ প্রমুখ।
শামসেত তাবরেজী বলেন, ‘আমি সাহিত্যের ছাত্র। কাজ করেছি মার্কেটিংয়ে। অনেকদিন চাকরি করেছি। এখন আর চাকরি করছি না। কোভিদের সময় ১০ মাস বাইরে যেতে পারিনি ঘরে ছিলাম। সে সময় এই ছবিগুলো একেছি। লকডাউন না হলেও আঁকতাম। কারণ এসবের মধ্যে থাকতেই আমার ভালো লাগে।’
ছবিগুলো প্রসঙ্গে কিউরেটর মুস্তফা জামান জানালেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি যদি ‘মানসবিশ্বের এমন এক পর্যায়, যার পরিচয় অনেকেরই অজানা’-এ মত স্তর থেকে জন্মে, তবে শামসেত তাবরেজীও এমন নিশ্চেতনার স্তর থেকেই ছবি আঁকেন। রবীন্দ্রনাথের মতো তাবরেজীও প্রামাণ্য আকার-আকৃতি থেকে দূরে থেকে সাকার বর্গীয় ছবির প্রণেতা হতে চেষ্টা করেছেন। বস্তুকে অপরিচিত বা নতুনতর মাত্রায় উন্নীত করে দর্শকের সামনে তুলে ধরেন।
কবি রবীন্দ্রনাথের ছবিতে বিভিন্ন জন্তুর আকার যেমন পাখি, সরীসৃপ, এমনকি কাল্পনিক সাপ হাজির হয়েছে। এগুলো নিরাকার আর আকারের দুনিয়ার মধ্যে মধ্যস্থতা করে। এইসব আদিমভাব প্রকাশকারী মূর্তির পাশাপাশি রবিঠাকুর তুলনামূলক সাবলীলতার সঙ্গে এঁকে রেখে গেছেন অজস্র জ্যামিতিক বা আর্কিটেকচারাল মুখাবয়ব ও শরীর-এগুলো অধিকতর নিরাকারমুখী। রবীন্দ্রনাথ ও তাবরেজী দুজনে সাকারবাদী হওয়া সত্ত্বেও শান্তিনিকেতনের কবি আর ঢাকার ক্রমবর্ধমান নাগরিক জটিলতার কবির ছবি দুই বিপরীত মেরুর প্রপঞ্চ তুলে ধরে।
ছবি আকার দিকে কেন ঝুকলেন এমন প্রশ্নের জবাবে এ শিল্পী বলেন, ‘আমি শিল্পসাহিত্যের সাথে সংযুক্ত। ছোটবেলা থেকেই আমি অন্য ধরনের আবহে বড় হয়ে উঠেছি তাই চিত্রকলার প্রতি আমার আলাদা একটা ঝোঁক ছিল। ২০১৯ সাল থেকেই চিত্রকলায় মগ্ন হলাম। ২০১৯ সালে একেছিলাম ৩৮ টি চিত্রকর্ম। এর মধ্যে কিছু বড় চিত্রশিল্পও ছিল। করোনাকালে একেছি ১৩০ টির মত ছবি। এই গ্যালারিতে ৫৭ টি চিত্রকর্ম ঝুলানো আছে। প্রদর্শনী চলেছে ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
নতুনদের মধ্যে অনেকেই ছবি আকার দিকে ঝুঁকছেন। এ বিষয়ে শামসেত তাবরেজী বলেন, ‘এখন তো অনেকেই ভালো ছবি আঁকছেন। এটা ভালো দিক। তবে সামাজিকভাবে আর্ট, সাহিত্য এগুলোকে মূল্য দিতে হবে। এই বিষয়ে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের রং সম্পর্কে, চিত্রকর্ম সম্পর্কে ধারনা দেওয়া উচিত। এখন সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু আর্ট গ্যালারি থাকলে ও তা পর্যাপ্ত নয়। পরাজধানীতে প্রত্যেক এলাকায় ১টি করে গ্যালারি করা গেলে খুবই ভালো হতো। আমি বিদেশে দেখেছি অনেকেই যারা শারীরিক ব্যায়াম করতে পার্কে বের হয় সেখানে আলাদাভাবে আর্ট গ্যালারি, ছোটখাটো কনভেনশন সেন্টার, জিমনেশিয়াম থাকে। এভাবে যদি করা যায় তাহলে নতুনরা আরো চিত্রকলার দিকে বেশি ঝুঁকবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি, বেরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগও জরুরি। সর্বোপরি আমাদের মন মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।’ করোনাকালে অনলাইন আর্ট প্রদর্শনী জনপ্রিয় হয়েছে। এ বিষয়ে তাবরেজী বলেন, আসলে উপায় না থাকায় করোনাকালে অনলাইন আর্ট প্রদর্শনী জনপ্রিয় হয়েছে। আসলে সরেজমিনে চিত্রকর্ম পরিদর্শনের পরিবর্তে অনলাইনে চিত্রকর্ম দেখা যেন দুধের স্বাদ ঘোল দিয়ে মেটানোর মতো।’ চিত্রশিল্পীর পাশাপাশি শামসেত তাবরেজী কবি হিসেবে জনপ্রিয়। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে ‘অশ্রু মোবারক’,‘বসা ভাতের ভৈরোঁ’।