লেবু চাষে ইনার সাফল্য

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

ফিচার

লেবু চাষে ইনার সাফল্য

  • নালিতাবাড়ী (শেরপুর) প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ১৮ জানুয়ারি, ২০১৯

আঁকাবাঁকা মেঠো পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় গ্রামটিতে। যাতায়াতের রাস্তা খুব খারাপ। ঝোপঝাড়ের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। কখনও আকঁড়ে ধরে কাঁটাযুক্ত লতা জাতীয় গাছ। পাখির কোলাহলে মুগ্ধ গ্রামখানি। পাহাড়ি জনপদ। চোখে পড়ে সামাজিক বণায়ন। পাহাড়ি সমতল। পায়ে হাঁটলে পায়ের নিচে পড়ে সবুজ ঘাস । সরু রাস্তার দু’পাশের মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে সবজি ক্ষেত। বিশেষ করে লাউয়ের আবাদ সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য সবজিও রয়েছে বেশ। কয়েক গজ সমানেই ভারত। ভারত ও বাংলাদেশকে ভাগ করেছে একটি নদী। দুটি দেশের সীমানা চিরে প্রবাহিত হয়েছে খরস্রোতা নদী ভোগাই। নদীতে রয়েছে হাঁটুজল। সীমান্তঘেঁষা ভারত বাংলাদেশের নর-নারীরা নদীতে ধরে মাছ। চোখে পড়ে ভারতীয় রাখালের গরু চড়ানোর দৃশ্য। নদীর বুকে জেগে ওঠেছে চর। বাংলাদেশীরা চর থেকে সংগ্রহ করছে বালু ও পাথর।

এই ভোগাই নদীর তীরে জিরো পয়েন্টে তারানী গ্রামটিতে গড়ে ওঠেছে বাংলাদেশের বসতি। অধিকাংশ পরিবার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর গারো সম্প্রদায়। পাহাড় আঁকড়ে যাদের জীবন ও জীবীকা। আবার এই তারানী গ্রামেই রয়েছে অপরুপ পাহাড়ি দৃশ্য। পাহাড়ি সু-উচ্চ টিলা। যা ভ্রমণ পিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। স্ব-ঘোষিত এই পর্যটনটিতে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ বনভোজন করে। মুগ্ধ হয় প্রকৃতির প্রেমে।

এই গ্রামটিতেই বাস করে ইনা মানখীন(৩০) নামে সহজ সরল আদিবাসী এক রমনী। স্বামী ও এক পুত্র এবং এক কন্যা নিয়ে তার সংসার। লেখাপড়ায় তেমন এগুতে পারেননি তিনি। এসএসসি পাস করেছেন ইনা । একটি বেসরকারী সংস্থায় সে শিক্ষকতাও করেছেন। কিন্তু ভাগ্য তাকে আটকিয়ে রেখেছে। গারো মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের রীতিমতো বিয়ের পর স্বামী নিয়ে সংসার শুরু করেন মাতৃলয়ে। শুধুমাত্র শিক্ষকতার সামান্য বেতন দিয়ে তার সংসার চলা খুব কঠিন। তার স্বামী একজন কৃষক। গারো সম্প্রদায়ের হওয়ায় ইনাকে কৃষির কথা বলতে হয় না। জন্মসুত্রেই তারা কৃষির সাথে জড়িত। তাই ইনা বেছে নেন অনাবাদী জমিতে ফলাবেন ফসল।

জীবনযুদ্ধে নেমে পড়েন তিনি। বাড়ির আশপাশেই তাদের পাহাড়ি জমি। হাতুড়ি শাবল গাইতি নিয়ে মাঠে নামেন ইনা। ছোট ছোট টিলা ও উঁচু নিচু জমি সমান করেন। বাবার মাধ্যমে মধুপুর থেকে নিয়ে আসেন ৭ হাজার লেবুর চারা। প্রতিটি চারা ক্রয় করেন ৩ টাকা করে। গত বছর সে তার জমিতে সেন জাতের লেবু চারা রোপন করেন। নিয়মিত পরিচর্যা করেন চারাগুলোর। লেবু গাছ হনহন করে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিন মাস পর থেকেই গাছে লেবু ধরতে শুরু করেছে। প্রতিটি গাছের কান্ডেই শোভা পাচ্ছে থোকা থোকা লেবু। ইনা সপ্তাহে ২ বার লেবু উত্তোলন করে বিক্রি করে সংসারের চাহিদা পূরণ করছেন। 

ইনা মানখীন বলেন, অল্প লেখাপড়া করে ভালো চাকুরি করা সম্ভব নয়। তাই মাতা-পিতার সামান্য জমিকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। ধান আবাদের তেমন সুবিধা না থাকলেও সবজি ও ফলমুল আবাদে রয়েছে বেশ সুবিধা। তাই  শুধু লেবুই নয় পাশের জমিতে রোপন করেছেন লিচু, মাল্টা, সুপারি। যা থেকে বেশ আয় হয় সংসারে। কাছেই নদী থাকায় লেবু ক্ষেতে পানি সেচ দেওয়া যায় সহজে। তবে সার ব্যবহারে বছরে খরচ হয় সবচেয়ে বেশি।
উৎপাদনে লক্ষমাত্রা অর্জন হলেও উৎপাদিত পণ্য তাদের বিক্রি করতে হয় অপেক্ষাকৃত কম দামে। বিশেষ করে লেবু একেবারে সস্তায় বিক্রি করতে হয়। কারণ তাদের যোগাযোগের রাস্তাটি খুব ভালো নয়। ভারী কোন যানবাহন রাস্তার কারণে সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। কাঁচা এই রাস্তাটি চলাচলের অনুপোযোগী। তবুও দু:খ নেই ইনার। লেবু আবাদ করে লাভবান তিনি। নিজেকে স্বাবলম্বী করেছেন লেবু ও অন্যান্য ফল চাষ করে। ইনা এখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। বছর শেষে তার সংসারে আয় দেখতে পাচ্ছে।

এক সময়ে তার সংসার ছিল অসচ্ছল। স্বামী সন্তান নিয়ে তাকে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হতো। আর লেবু চাষ করে তার ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। তাছাড়া যে জমি বছরের পর বছর থাকতো অনাবাদী। ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। বর্তমানে সেই জমিতে শোভা পাচ্ছে হাজার হাজার লেবু গাছ। থোকায় থোকায় ঝুলছে লেবু। নিজেকে একজন আধুনিক কৃষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ইনা। নিজেকে একজন গর্বিত নারী কৃষক হিসেবে গড়ে তুলেছেন।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফ ইকবাল বলেন, লেবু চাষের উপযোগি পাহাড়ি অঞ্চলের ভূমি। শুধু লেবুই নয় মাল্টা চাষে সাফল্য আসছে পাহাড়ি অঞ্চলে। এতে ধানের চেয়ে বেশি লাভবান হওয়া যায়। আদিবাসী নারীদের মাঝে লেবু চাষ করে ইনা নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করে কৃষিতে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বলে জানান, ট্রাইবাল ওয়েল ফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারন সম্পাদক লরেন্স বনোয়ারী সহ আদিবাসী অনেকেই।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads