নির্বাচনের আগে আবারো সক্রিয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থার নতুন অনুসন্ধানে উঠে আসছে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা দুর্নীতির অনুসন্ধান। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তলবি নোটিশ পাঠাচ্ছেন দুদক কর্মকর্তারা। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অভিযুক্তদের বিদেশ গমনেও আরোপ করা হচ্ছে নিষেধাজ্ঞা।
দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন বুধবার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, তদন্ত-অনুসন্ধান দুদকের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। তবে এটিকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকারের প্রতিপক্ষ দমন কৌশল বলে অভিহিত করেছেন বিশ্লেষকরা। তাদের দৃষ্টিতে আলোচিত বেসিক ব্যাংকের মতো ব্যাংক জালিয়াতি, রিজার্ভ চুরি, কয়লা চুরি, পাথর চুরি, ভল্টের সোনা গায়েব, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান-তদন্তগুলোকে ডিপফ্রিজে রেখে হঠাৎ করেই দুদক সামনে নিয়ে এসেছে রাজনৈতিক সম্পর্কযুক্ত তদন্ত ও অনুসন্ধানগুলো।
দুদক বলছে, রাজনৈতিক সম্পর্কযুক্ত অন্তত অর্ধশত মামলা এখন নতুন করে প্রাণ পেয়েছে। এসব তদন্ত এবং অনুসন্ধান দীর্ঘদিন ডিপফ্রিজে ছিল। নতুন কিছু অনুসন্ধান-তদন্তও যোগ হয়েছে। এসব কারণে গণমাধ্যম এখন মুখর সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুদকে তলব-জিজ্ঞাসাবাদ নিয়ে। এ প্রক্রিয়ায় দুদকের কল্যাণে নতুন করে সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন রাজনীতিতে নীরব থাকা সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ। ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর দায়ের করা একটি মামলায় গত সোমবার তার বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে দুদক। চার্জশিটে তার বিরুদ্ধে প্রায় ২ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায় কিশোরগঞ্জের কাগজ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. আওলাদ হোসেনকেও আসামি করা হয়েছে।
সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী রুহুল কুদ্দুস দুলু বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। ২০০৭ সালে তার বিরুদ্ধে ৯ কোটি ৩০ লাখ টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলা হয়। হাইকোর্টের নির্দেশে ওই বছর ২৯ আগস্ট মামলার তদন্ত স্থগিত থাকে। মামলার তদন্ত প্রক্রিয়ায় ১১ বছর পর গত ৭ অক্টোবর দুদকের সহকারী পরিচালক মো. শফিউল্যাহ তাকে তলবি নোটিশ পাঠান। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং তার স্ত্রী তাহেরা আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। সম্পদ অনুসন্ধান পর্যায়ে এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের নজির খুব একটা নেই। তা সত্ত্বেও গত ৫ অক্টোবর দুদকের পরিচালক কাজী শফিকুল আলম পুলিশের বিশেষ শাখা এবং পুলিশ সুপার (ইমিগ্রেশন) এ নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিঠি দিয়েছেন। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচার ও স্থানান্তরের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির অনুসন্ধান এখন ডিপফ্রিজে। তবে সক্রিয় করা হয়েছে প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি অনুসন্ধান। এ প্রক্রিয়ায় গত আগস্ট থেকে জোর অনুসন্ধান চলছে। এতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মির্জা আব্বাস, দলটির দুই ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও এম মোর্শেদ খান, যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল, এম মোর্শেদ খানের ছেলে খান ফয়সাল মোর্শেদ খানকে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাদের বিষয়ে রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করা হচ্ছে।
জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অনুসন্ধান করছে গত আগস্ট থেকে। তাকে একাধিকবার তলবও করা হয়েছে। সংস্থার উপপরিচালক সৈয়দ আহমেদ তার বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে জাপার এই নেতা বলেন, দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে চাপে রাখতেই দুদক নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করেছে।
নির্বাচনের আগে দুদকের বর্তমান তৎপরতা সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি, ভল্টের সোনা চুরি, রিজার্ভ চুরি, ব্যাংকের বড় বড় দুর্নীতি রেখে এ মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতাদের ফাইল নিয়ে টানাটানি মানুষের মাঝে সন্দেহ সৃষ্টি করবে। মানুষ ধরেই নেবে দুদক নির্বাচনকে সামনে রেখে উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব করছে। যদিও আমরা বিশ্বাস করতে চাই দুদক স্বশাসিত স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এটি সরকারের নির্দেশে চলে না।
একই প্রশ্নে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, যেকোনো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক অনুসন্ধান-তদন্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাপারটি যদি ‘পিক অ্যান্ড চ্যুজ’র বিষয় হয় তাহলে প্রতিষ্ঠানটি জনমনে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি করবে। নির্বাচনের আগে দুর্নীতি অনুসন্ধান-তদন্তের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির আরো দায়িত্বশীল এবং সতর্ক ভূমিকা পালন করা উচিত। যাতে দুদক সম্পর্কে এ ধারণা সৃষ্টি না হয় যে, সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন কিংবা নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।