মোহাম্মদ শাহিন
যৌতুকের কারণে নিত্য দাম্পত্য কলহ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং স্ত্রী হত্যার মতো জঘন্য অপরাধপ্রবণতা যে বাড়ছে তা সহজেই অনুমেয়। বিবাহিত নারীর প্রতি অত্যাচার ও সহিংতার মূল কারণ আজ যৌতুক। শুধু যৌতুকের কারণে একটি মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে অকথ্য নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। যৌতুকের দাবি-দাওয়া পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় অধিকাংশ দাম্পত্য জীবনে কলহ, বিবাহবিচ্ছেদ এবং আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর রিপোর্টে উঠে এসেছে, দেশের ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে যার সিংহভাগ শুধু যৌতুকের কারণে। নারী অধিকার সংরক্ষণের রিপোর্ট অনুযায়ী, শুধু ২০১৮ সালে যৌতুকের কারণে ১০২ জন নারীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং আত্মহত্যার শিকার হয় ৪ জন নারী। দৈনিক পত্রিকায় নাটোরের গুরুদাসপুরে যৌতুকের টাকা না পেয়ে গৃহবধূর মুখে বালিশ চেপে মারপিটের পর জ্বলন্ত সিগারেটের আগুন দিয়ে স্পর্শকাতর জায়গসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত করে দেয় তার স্বামী মিঠুন আলী। এমন খবরে বাকরুদ্ধ না হয়ে উপায় ছিল না।
বিষণ্ন মনে ভাবলাম, আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হলেও নারীর ক্ষেত্রে আমাদের মানসিকতার কোনো উন্নয়ন হয়নি। ‘যৌতুক দেব না, যৌতুক নেব না’ এই বুলি আমরা কম-বেশি সবাই আওড়াই অথচ আজকাল যৌতুক ছাড়া কোনো বিয়ে-শাদি হয় না বললেই চলে। যুগের পরিবর্তনে এটি ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। যৌতুক যেন সমাজের ছেলেরা অধিকারের মধ্যেই ধরে নিয়েছে, কেউবা যৌতুককে আখ্যায়িত করছেন নতুন উপহার হিসেবেও। যৌতুক সমাজের মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে।
আমাদের দেশে যৌতুকের পেছনে রয়েছে নানা কারণ। তন্মধ্যে দারিদ্র্য প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত। দারিদ্র্যের কারণেই আমাদের দেশের অধিকাংশ বরপক্ষ কনেপক্ষের কাছে অর্থ-সম্পদের দাবি-দাওয়া করে থাকে। বাদ যাচ্ছে না যৌতুকের নতুন নাম ‘উপহার’ দিয়ে বহু সচ্ছল পরিবার ও শিক্ষিত সচেতন নাগরিকের যৌতুক দেওয়া-নেওয়া। আমাদের সমাজের ছেলেরা কনের পিতার অর্থ ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চায়। এদেশের অধিকাংশ নারী গৃহকর্মে কর্মস্থল থেকে পরনির্ভরশীল হয়ে স্বামীর সংসারে জীবন-যাপন করে। ফলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের সুখের জন্য এবং মেয়ে যাতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে সেজন্যও যৌতুক প্রথা সমাজে দিন দিন ব্যাপকহারে বিস্তার লাভ করছে।
যৌতুকের কারণেই মূলত বাল্যবিবাহের হারও দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। মেয়ের বয়স কম হলে যৌতুক কম দিতে হয় আর বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হয় এমন একটি কুপ্রথার ধারণা থেকেও অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে বাল্যবিবাহ বাড়ছে যা সম্প্রতি ইউনিসেফ অশনিসংকেত হিসেবে অভিহিত করছে। তাছাড়া যৌতুকের দাবি মিটাতে অনেক দরিদ্র পরিবারের যেখানে তিন বেলা ঠিকমতো অন্ন জোটে না সেখানে শ্বশুরবাড়িতে শুধু মেয়ের নির্যাতনের মাত্রা হ্রাস এবং সুখের জন্য মোটা অঙ্কের সুদে ঋণ করে বরপক্ষকে যৌতুক দিচ্ছেন। এতে অনেক কনেপক্ষের পরিবার বেঁচে থাকার অবলম্বন ভিটে-মাটি বিক্রি করে নিঃস্বও হয়ে পড়ছেন।
আমাদের দেশে যৌতুক বন্ধে ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইন অনুযায়ী যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে সর্বোচ্চ ১ বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হতে পারে। ১৯৮৬ সালে এ আইন সংশোধিত করে বলা হয়েছে, কেউ যৌতুক প্রদান বা গ্রহণ করলে সর্বনিম্ন ১ বছর এবং সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। ১৯৮৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের বিধান অনুযায়ী যৌতুকের কারণে নারীর মৃত্যু ঘটলে বা ঘটানোর চেষ্টা চালালে অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। এত কঠিন আইন থাকা সত্ত্বেও উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে যৌতুক প্রথার বিস্তার। বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ বলছেন, বাংলাদেশে যদিও যৌতুকের শক্ত আইন রয়েছে কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা করে না কেউ। কেননা আইনের যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে। যদিও যৌতুকের কারণে খুব বেশি মামলা হয় না তবুও যা হয় তার ৯০ শতাংশ বিচার পায় না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং দীর্ঘসূত্রতার কারণেও যৌতুক প্রথা লাগামহীনভাবে ছুটে চলেছে।
যৌতুক বাংলাদেশের পরিবার ও সমাজব্যবস্থায় নারীর প্রতি কতটা সহিংস প্রথা, তা বলার অবকাশ রাখে না। সুতারাং যৌতুক নামে মানবতার সাথে ঘৃণ্য কৌতুক প্রতিরোধ করতে সবাই এগিয়ে আসার বিকল্প নেই। যৌতুক প্রতিরোধ করতে প্রথমেই সচেতন করতে হবে নিজ পরিবারকে এবং একই সঙ্গে আমাদের প্রতিবেশী তথা পাড়া-মহল্লা-গ্রামের মানুষকে। তাদের বোঝাতে হবে যৌতুকের ভয়ংকর কুফল সম্পর্কে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত যৌতুকবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালানো যেতে পারে। পরিবারের কন্যাসন্তানসহ সবাইকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে আত্মনির্ভরশীল রূপে গড়ে তুলতে হবে, তাহলে যৌতুকের অভিশাপ কিছুটা লাঘব হতে পারে। সেজন্য সরকারকে কারিগরি শিক্ষার প্রতি জোর দিতে হবে এবং মধ্যবত্তি ও নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের প্রতি শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা দূর করে উচ্চশিক্ষায় গড়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে। প্রতিটি এলাকায় যৌতুকবিরোধী বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলন গড়ে তার প্রচলন করতে হবে। যৌতুকের কারণে নির্যাতিত নারীর পাশে দাঁড়ানো, আইনি সহায়তার ক্ষেত্রে এলাকার শিক্ষিত, সচেতন এবং মূল্যবোধসম্পন্ন তরুণসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় নারীর প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সম্মান দেখানোর শিক্ষা এবং নারীর প্রতি সহানুভূতি সম্পর্কে পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই শিশুর পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ গঠনে অভিভাবককে সুদৃষ্টি দিতে হবে। নারীর ন্যায্যতা, বাল্যবিবাহ বন্ধ এবং নারীর সম্মানজনক অবস্থায় ফিরতে এই কুপ্রথা বন্ধ করতেই হবে। মনে রাখতে হবে, প্রচ্ছন্ন যৌতুক থেকে সমাজব্যবস্থা মুক্তি পেলে, নারীরা পাবে সহিংসতামুক্ত স্বাচ্ছন্দ্যময় নতুন পরিবার।
লেখক : শিক্ষার্থী
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়