ভারতীয় পাইলট উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানে সারা ভারতের বীর হয়ে, বীরের সংবর্ধনা নিয়ে দেশে ফিরে গেলেন। পাকিস্তানিদের কাছে ধরা ও কাশ্মিরের শিশু-কিশোরদের হাতে মার খেয়ে, পাকিস্তানি মেজরের সঙ্গে বসে আয়েশ করে চা পান করে চাক্ষুষ দুনিয়ায় ভারতীয় বীর হলেন! পাকিস্তানে মিগ-২১ যুদ্ধবিমান নিয়ে হামলা চালাতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন অভিনন্দন। পাকিস্তান জেটের এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল আঘাত করে অভিনন্দনের মিগে। এতে বিমান নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে রেডিও বার্তা দিয়েই ‘ইজেক্ট’ করে বিমানের ককপিট থেকে বাইরে চলে আসেন তিনি। অভিনন্দনকে নিয়ে প্যারাসুট ভেসে যায় পাক অধিকৃত কাশ্মিরের দিকে। তারপরই পাক সেনারা আটক করেন তাকে। এখানে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সবচেয়ে বড় অর্জন হলো, তাদের নিজেদের অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্সে তৈরি মাল্টিরোল ফাইটার ‘জেএফ-১৭ থান্ডার’ দিয়েই পাল্টা প্রতিরোধ চালিয়ে ভারতীয় বিমান ভূপাতিত করা।
ভারত প্রথমত স্বীকারই করেনি তাদের বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে, পাইলট নিখোঁজ রয়েছে। পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) ও পাকিস্তানের দৈনিক ডন অনলাইন ভিডিও প্রকাশ করায় ভারতের তখন অস্বীকারের উপায় থাকে না! ভিডিওতে ওই ব্যক্তি নিজের নাম অভিনন্দন ও বাড়ি দক্ষিণ ভারতে বলে উল্লেখ করেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘এখানে আমি সুচিকিৎসা পাচ্ছি...। ভারতেরও উচিত এমন পথ অনুসরণ করা।’ পাকিস্তানিদের সঙ্গে আরাম-আয়েশ করে চা পানের দৃশ্য প্রকাশ না করলে ভারত বৈমানিক হারানোর কথা স্বীকার করতো কি? শুধু তা-ই নয়, অভিনন্দনের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেও পাকিস্তানি আর্মি আশ্বস্ত করেছে, ‘আপনাদের ছেলে আমাদের জিম্মায় ভালো আছে এবং অতি শিগগির তাকে ভারতে ফেরত পাঠানো হবে।’ পাক প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা করেন, শান্তির পদক্ষেপ হিসেবে অভিনন্দনকে মুক্তি দিয়ে ভারতের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এর আগে কার্গিল যুদ্ধের সময়ও আটক ভারতীয় পাইলট নচিকেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিল পাকিস্তান।
ভারতীয় পাইলট ফেরত দেওয়াকে অনেকেই ভারতের বিপক্ষে পাকিস্তানের দুর্বলতা ও জেনেভা কনভেনশনকে চিহ্নিত করছেন। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, যুদ্ধ কখনোই অর্থনীতির ধার ধারে না। যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া, আফগানিস্তান, সাউথ সুদান, বসনিয়া, হার্জেগোভিনায় কি এমন অর্থনীতি ছিল- যেখানে যুদ্ধ চলেছে বছরের পর বছর ধরে।
পাকিস্তান আক্রমণ করেছিল দিনের আলোয়। আর ভারত রাতের আঁধারে কথিত জঙ্গি আস্তানা উড়িয়ে দিয়ে ৩০০ লাশ ফেলে দেওয়ার খবর চাউর করে। যার কোনো প্রমাণ বিশ্বমিডিয়াকে দেখাতে পারেনি। তাহলে কি ভারতীয় সেনাবাহিনী জঙ্গিদের লাশ সৎকার সেরে এসেছিল! যা পাকিস্তান বা কাশ্মিরের কেউ টেরই পায়নি! খাইবার-পাখতুনওয়ারায় ভারতীয় হামলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারতীয় বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর পাকিস্তানিরাও যুদ্ধ-উন্মাদনায় ভালোভাবেই শরিক হয়েছে। তবে কোনো ধরনের বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা না করে পাক আর্মি পরিমিতি বোধের পরিচয় দিয়েছে। উপরন্তু একজন পাইলটকে হাতে পাওয়ার পরও ইমরান খান নাটকীয়ভাবে ভারতের প্রতি সংলাপের আহ্বান জানিয়ে বিশ্ব প্রচারমাধ্যমে কিছুটা সুবিধাজনক ইমেজ তৈরি করতে সক্ষম হন। তবে ইলেকশনকে সামনে নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা থেকে যে লাভ মোদি করতে চেয়েছিলেন, অভিনন্দন আটক তাতে জল ঢেলে দিয়েছে। ইমরান খান মোদির বানানো নাটকেই যে হিরো হয়ে যাবেন, তা মোদি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
পাকিস্তান ১৯৯০-এ তার দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘নিশান-ই-পাকিস্তান’-এ ভূষিত করেছিল ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইকে। পাকিস্তান ও ভারতে কেউই হয়তো এ মুহূর্তে মনে করছে না, আপাতত দুই দেশের মধ্যে অতীতের সেই হূদ্যতা আর ফিরে আসবে এবং কোনোরূপ সমঝোতা বা শান্তি আলোচনা সম্ভব! বিশেষ করে ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের যে প্রচণ্ড ঢেউ বইছে, তাতে ভারতের কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে আর অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করার অবকাশ আছে কি? পুলওয়ামা ঘটনার পর আরএসএসের ছাত্রসংগঠন এবিভিপি হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। মেঘালয়ের রাজ্যপাল কাশ্মিরের সব পণ্য বর্জন ও কাশ্মিরের লোকদের যেখানেই পাওয়া যাবে, সেখানেই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। একটি রাজ্যের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে থেকে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া কতখানি ধৃষ্টতা, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
পুলওয়ামার ঘটনার পর থেকে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ভারতীয় প্রচারমাধ্যম বিশেষত মোদিপন্থি মিডিয়াগুলো পুরো দেশকে ধর্ম ও জাতিবাদী এক উত্তেজনায় মাতিয়ে তোলে। চলতি যুদ্ধাবস্থার দায় অনেকটা এসব প্রচারমাধ্যমের ওপরও বর্তায়। যার কথা স্বয়ং অভিনন্দনই স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী খুবই পেশাদার। এ মন্তব্য করে ভারতীয় পাইলট আরো বলেন, ‘আমি দেখেছি, সেখানে শান্তি আছে। পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আমি সময় কাটিয়েছি এবং আমি খুব অভিভূত।’ তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভারতীয় গণমাধ্যম সবসময় সত্যকে এদিক-সেদিক করে প্রকাশ করে। খুব সামান্য বিষয়কেও তারা এমন উসকানিমূলকভাবে উপস্থাপন করে, যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়।’ কাশ্মিরে আজাদীর আন্দোলন চলছে প্রায় ৯০ বছর হলো। তাদের ৪৪ জন জওয়ান নিহত হওয়ার আগেও দশকের পর দশক ধরে সেখানে মানুষ মরছে। সুতরাং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, যা করলে এই অঞ্চলে চিরস্থায়ী শান্তি আসে, তা-ই করতে হবে। পাকিস্তানের বালাকোটের বনাঞ্চলে কোনো কল্পিত লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালালেই কাশ্মিরে শান্তি স্থাপিত হয়ে যাবে না। কেবল ২০১৮ সালে কাশ্মিরে প্রায় ৩০০ স্থানীয় গেরিলার পাশাপাশি ১৫০ জন ভারতীয় সৈনিকও মারা গেছে। আহত-নিহত বেসামরিক মানুষের সংখ্যাও অগণন। এ মুহূর্তে পরিস্থিতি বিবেচনায় ভারত-পাকিস্তান উভয়কেই কৌশলে এগুতে হবে। বরাবরই ভারত-পাকিস্তানের এই মুখোমুখি অবস্থান উপমহাদেশে দীর্ঘমেয়াদি একটা অশান্তির ডামাডোল লেগে থাকে। হামলার প্রতিক্রিয়ায় ও পাল্টা আক্রমণে সার্জিক্যাল অ্যাটাক, এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসার পথ ভারত ও পাকিস্তানকে খুঁজতে হবে। কাশ্মির সমস্যা জিইয়ে রেখে কোনো পক্ষই লাভবান হতে পারবে না। কারণ যুদ্ধ কোনো পিকনিক নয়। পৃথিবীর সব যুদ্ধই হচ্ছে ভুল হিসাবের ফল। যুদ্ধে কেউই জেতে না, জেতে শুধু অশান্তি ও সন্ত্রাসবাদ।
সুতরাং এই মুহূর্তে উভয় দেশের শান্তিপ্রিয় সচেতন জনগণের উচিত হবে, শান্তির পক্ষে সরব হওয়া। শত-সহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তোলা- যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। বিষয়টির রাশ টানা সম্ভব না হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা চাপের মধ্যে পড়তে পারে। উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গঠিত ভারত ও পাকিস্তান কালক্রমে পরস্পরকে টার্গেট করেই পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়েছে। পারমাণবিক যুদ্ধকে যদি এ দুটি দেশের প্রত্যক্ষ করতে হয়, তাহলে তার ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা হিরোশিমা-নাগাসাকি থেকেও বহুগুণ ছাড়িয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক
abunoman1972@gmail.com