ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ মুসলমানদের অনুভূতি উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং তার আগের বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন। আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি মুসলমানদের অনুভূতি বুঝতে পারছি এবং আমি তাদের শ্রদ্ধা করি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আজ বিশ্বে এমন কিছু লোক আছে যারা ইসলামকে বিকৃত করছে, তারাই আবার ইসলাম রক্ষার ঝান্ডা হাতে তুলে নিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করছে, সহিংসতা চালাচ্ছে।’
সন্ত্রাসের শিকার মুসলমানরাই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদে আক্রান্ত শতকরা আশি ভাগেরও বেশি মুসলমান।’ এত সুন্দর সুন্দর কথা বলে ম্যাখোঁ মুসলমানদের বন্ধু হয়ে গেলেন— এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে কথাগুলো যে সত্য, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ম্যাখোঁ যা বলেছেন এবং বলছেন, তার একটা স্বার্থ আছে। অনেক বিশ্লেষণেই এসেছে তিনি একজন রাজনীতিবিদ এবং সামনে তার দেশের নির্বাচন। তাকে একদিকে যেমন নিজ দেশের পাবলিক সেন্টিমেন্টকে ধরে রাখতে হবে, তেমনি বয়কটের মতো পরিস্থিতিতে তার নিজ দেশের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে।
এবার আসা যাক ম্যাখোঁর কথায় উগ্রবাদ আর সন্ত্রাসবাদের শিকার আসলে কারা। শুধু যদি ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান ধরি তাহলে দেখা যায় যে, ওই বছর বিশ্বজুড়ে ছোটবড় প্রায় ৮ হাজার সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। এসব হামলায় হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার মানুষ। কোথায় কোথায় ঘটেছে? শুধু আইএস দ্বারা সংঘটিত বড় বড় হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগ ঘটেছে মুসলিম দেশগুলোতে, যেমন— সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, তাজিকিস্তান ও মিশরে। এছাড়াও ঘটেছে ফ্রান্সে যাতে মারা যায় ৫ জন, রাশিয়ায় ৬+৪২=৪৮ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ১ জন, বেলজিয়ামে ৪ জন। হিসাবটা খুব সহজ। অমুসলিম দেশগুলোতে হত ৬০ জনের কাছাকাছি, আহত প্রায় ২০০। বাকিরা কারা? প্রশ্ন থেকে যায়, যারা মারা গেল কিংবা আহত হলো, তারা কি সবাই ধর্মবিরোধী ছিল?
এটা গেল প্রত্যক্ষ ক্ষতি। ইউরোপ, আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে সংঘটিত হামলায় হয়তো অন্য ধর্মের কিছু লোক ক্ষয় হয় কিন্তু তার পরোক্ষ ক্ষতিটা বহন করতে হয় ওইসব দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু মুসলমানদের। কেউ কেউ বলবেন, এসব তো ইউরোপ, আমেরিকাই করাচ্ছে। এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে তারাই লালন-পালন করছে! অভিযোগ যে একেবারে ভিত্তিহীন, তা নয়। আবার সন্ত্রাস শুধু মুসলমান নামধারীদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে এমন তো নয়! তবে মুসলমানদের বুঝতে হবে এর পেছনে কারা, ক্ষতি হচ্ছে কাদের, কীভাবে ইসলামের নামে এসব উগ্রতা প্রতিরোধ করা যায়।
একসময় পুরো পৃথিবীর কিছু এলাকা বাদে প্রায় সবটাই দুটি কলোনিতে বিভক্ত ছিল। তার একটা ব্রিটিশ কলোনি অন্যটা ফ্রান্সের। এপির বিশ্লেষণ (৩১ অক্টোবর প্রকাশিত) থেকে জানা যায়, ফ্রান্স বার বার মুসলিম বিশ্বে যে ক্ষোভ উসকে দিচ্ছে, তার অন্যতম কারণ ফ্রান্সের রয়েছে অত্যন্ত নির্মম ঔপনিবেশিক অতীত, আছে কট্টর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি আর আছে কঠোর কথাবার্তা বলায় পারদর্শী রাষ্ট্রপ্রধান— এর সবগুলোই মুসলিম বিশ্বাসের প্রতি অসংবেদনশীল ভূমিকা পালন করে চলেছে। অবশ্য শুধু ফ্রান্সেই নয়, অন্য কিছু দেশেও মুসলিম সংখ্যালঘুদের জঙ্গিবাদের ধুয়া তুলে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা চলছে, সংখ্যাগুরুদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছে— ক্ষমতায় থাকাই যার মূল লক্ষ্য।
অন্যদিকে মুসলিম বিশ্বও আজ শতধাবিভক্ত। তারা এসবের প্রতিবাদে অক্ষম। ব্যক্তিবিশেষ কিংবা দল বা গোষ্ঠীকেন্দ্রিক প্রতিবাদ, আন্দোলন খুব বড় কিছু ফল দেয় না। জনসম্পর্কহীন রাজা, রাষ্ট্রনায়ক দ্বারা প্রতিবাদ আশা করাও যায় না। কারণ তারা চায় ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে। তাতে তাদের সমর্থন প্রয়োজন ওইসব শক্তিধর দেশের যারা মুসলিম বিশ্বাসের প্রতি অসংবেদনশীল। কয়েকটি দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমরা তো তাদের অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের মুসলিম পরিচয় মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে।
বিশ্বাসী মানুষের কাছে ধর্ম হচ্ছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। নিজে ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা কতটা পালন করল তা বিবেচ্য বিষয় আর থাকে না, যখন দেখে যে তার ধর্মের অবমাননা হচ্ছে। আর তখন সে নিজ জীবনকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিবাদে। তবে এই প্রতিবাদও হওয়া উচিত ধর্মের সীমা মেনে। ইসলাম রক্ষার নামে অনর্থ করে বসা বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে না। আবার নিরীহ মানুষ হত্যা সে যে ধর্মেরই হোক, ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামকে বলা হয় সহনশীল ধর্ম। অথচ কিছু ব্যক্তি, গোষ্ঠীর আচরণে তার প্রমাণ মেলে না।
ইসলামে নিরীহ নির্দোষ ব্যক্তি হত্যা করা মহাপাপ এবং সেটা আল্লাহ প্রদত্ত সীমা লঙ্ঘন করার শামিল। যেমন বলা হয়েছে, আল-কোরআনের সুরা মা’য়িদার ৩২ নম্বর আয়াতে : ‘নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা হেতু ছাড়া কেউ কাউকে হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ায় সব মানুষকেই হত্যা করল; আর কেউ কারো প্রাণরক্ষা করলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। তাদের কাছে তো আমার রাসুলগণ স্পষ্ট প্রমাণ এনেছিল; কিন্তু এর পরও তাদের অনেকে দুনিয়ায় সীমা লঙ্ঘনকারীই রয়ে গেল।’ বুখারি ও মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে, ‘কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয় নিয়ে ফয়সালা হবে তা হলো রক্তপাত (হত্যা) সম্পর্কিত।’
সস্তা আবেগ আর গুজবে কান দিয়ে আমরা অনেক অনর্থ করে ফেলি। ধর্মকে না বুঝে ধর্ম সম্পর্কে না জেনে, ভাসা ভাসা জ্ঞান নিয়ে অনেক তর্ক করি। মানুষকে পিটিয়ে, আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে মানুষ! অথচ তারাই আবার দাবি করে তারা মুসলমান। আর এসব মূর্খের হাতে প্রাণ যায় নামাজি, ধর্মপ্রাণ শহীদুন্নবীর মতো লোকদের।
নিরীহ মানুষকে বিনা দোষে মেরে ফেলার মতো ভয়াবহ পাপ আর কী হতে পারে? এই যে শহীদুন্নবীকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হলো, সেখানে কিছু কি মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ছিল না? থাকতে পারত না? আশপাশে কি হাফেজ, কারি, মাওলানা সাহেবরা ছিলেন না? বিবেকসম্পন্ন মানুষের কি এতই অভাব আমাদের সমাজে? তাহলে আমরা কীভাবে দাবি করি আমরা মুসলমান?
হত্যা এখন এক মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামান্য কারণে আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ি, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠি। গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে- ঘরে হচ্ছে, বাইরে হচ্ছে। অথচ আমরা দাবি করছি আমরা মুসলমান! মুসলমানের দেশে তো শান্তি বিরাজ করার কথা, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই নিরাপদ থাকার কথা! মুসলিম সমাজে শহীদুন্নবীর মতো ধার্মিক লোকদের জন্য তো নিরাপদ স্বর্গ হওয়ার কথা! আপনি নিরাপদে বাড়ি ফিরবেন কিংবা বাড়িতে আপনি নিরাপদে থাকবেন— এর নিশ্চয়তা কই?
সামান্য সম্পত্তির লোভে পুরো পরিবারকে হত্যা করছে, যৌনতার কারণে মা, বোন, মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে, শিশু শিক্ষার্থীরা বলাৎকারের শিকার হচ্ছে, সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা হচ্ছে, আকছার মিথ্যার চর্চা হচ্ছে— অথচ এর সবগুলোই ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। মুখে আমরা ইসলাম মহান ধর্ম বলে খই ফোটাই ঠিকই, কিন্তু বাস্তবে তা অনুসরণ করি কোথায়? মানবিক মূল্যবোধ হারালে মানুষ আর মানুষ থাকে না, পশুতে পরিণত হয়। সমাজে ফেতনা-ফ্যাসাদ, মানবিক বিপর্যয় আর অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে আল্লাহর গজব নেমে আসে। সেখান থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ ধর্মের সঠিক শিক্ষা ও উপলব্ধি এবং সে অনুযায়ী আমল। আর এই ধর্মীয় শিক্ষা, সঠিকভাবে মানুষকে বোঝানোর দায়িত্ব যেমন ব্যক্তি ও পরিবারের, তেমনি এই গুরুদায়িত্ব নিতে পারেন ধর্মীয় নেতারা।
লেখক : সাংবাদিক