মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যা, নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্তের দাবি জানিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন জানিয়েছে রোহিঙ্গাদের পক্ষে আইনজীবীরা। গতকাল বুধবার দেশটির সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনের এ ঘটনা তদন্ত এবং দায়ীদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ৪০০ রোহিঙ্গার পক্ষে আইনজীবীরা আবেদন জানান। খবর স্কাই নিউজের।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের গত মঙ্গলবার প্রকাশিত ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা সত্ত্বেও চলমান নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি নেইপিডো।
মিয়ানমার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। তবে আইন বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, দেশটির সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর যে নিধনযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে তার আওতা বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। আর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ায় নিধনযজ্ঞের দায়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আন্তর্জাতিক বিচার সম্ভব।
মিয়ানমার আইসিসির সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলে আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারব্যবস্থাকে অনুমোদন করে না। তাই আন্তর্জাতিক আদালতকে রাখাইন পরিস্থিতি অবহিত করার বিষয়টি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মিয়ানমারের মিত্র দেশ চীন এবং রাশিয়া এ ধরনের পদক্ষেপ বন্ধ করে দিয়েছে। তাই রোহিঙ্গা বিতাড়নকে সম্ভাব্য মানবতাবিরোধী অপরাধ বিবেচনা করে মিয়ানমারের বিচার শুরু করা যায় কি না; গত ৯ এপ্রিল সে ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে আইসিসিতে আবেদন করেন এর কৌঁসুলি ফাতাও বেনসুউদা।
কয়েকদিনের মাথায় এক বিবৃতিতে মিয়ানমার সরকার অপরাধ আদালতের কৌঁসুলির পদক্ষেপকে ১৯৬৯ সালের জাতিসংঘের ভিয়েনা চুক্তি ও আইসিসি সনদের প্রস্তাবনার ‘লঙ্ঘন’ আখ্যা দেয়। একই দিনে পাল্টা বিবৃতিতে আইসিসির কৌঁসুলিদের দফতর থেকে বলা হয়, রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় মিয়ানমারের বিচারের ব্যাপারে নির্দেশনা চেয়ে আইসিসিতে করা কৌঁসুলি বেনসুউদার আবেদন, এ বিষয়ে তার পূর্ণ সতর্কতার বহিঃপ্রকাশ। ওই বিবৃতিতে দাবি করা হয়, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে কৌঁসুলিদের প্রবল আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তারা কোনো দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি পূর্ণ সম্মান ও বিচারব্যবস্থার আওতার মধ্যে থেকেই তা করতে চান।
‘সম্ভাব্য অপরাধের একাংশ নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। তাই আইসিসির আওতায় মিয়ানমারের বিচার সম্ভব।’ বলেও কৌঁসুলিদের দফতর থেকে দেওয়া বিবৃতিতে দাবি করা হয়।
রোহিঙ্গাদের আইনজীবীরা বুধবার আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়ে যুক্তি দেখান যে, আইসিসির উচিত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করার জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তদন্ত চালানো ও দেশটিকে বিচারের মুখোমুখি করা। রোহিঙ্গাদের আশঙ্কা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা না হলে এ ধরনের অপরাধ চলতে থাকবে এবং অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপরও নিপীড়ন ছড়িয়ে পড়বে।
আইনজীবীরা আদালতে যুক্তি উপস্থাপনকালে আরো বলেন, নিপীড়িত রোহিঙ্গারা যেহেতু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে এবং বাংলাদেশ আইসিসিভুক্ত দেশ, সেক্ষেত্রে মিয়ানমারকে জবাদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব।
মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কেবল একটি ঘটনায় সেনা সদস্যদের অভিযুক্ত করেছে। ইনদিন গ্রামে ১০ রোহিঙ্গাকে হত্যার ঘটনায় সাত সেনাকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিধনের ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে আটক হওয়া দুই রয়টার্স সাংবাদিককে এখনো আটক করে রাখা হয়েছে।
এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা সত্ত্বেও চলমান নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি নেইপিডো। গত মঙ্গলবার ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।
প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবস্থা তুলে ধরা হয়। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিধনযজ্ঞের তীব্র সমালোচনা অব্যাহত রেখেছে। তা সত্ত্বেও মিয়ানমার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
গত বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ বলে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ। গত নভেম্বরে মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকেও রোহিঙ্গা নিপীড়নকে নিধনযজ্ঞ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে দেশটি।
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ধর্মীয় স্বাধীনতাবিষয়ক প্রতিবেদনে মিয়ানমার থেকে ৬ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার তথ্যও লিপিবদ্ধ হয়েছে। মঙ্গলবার মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্যাম ব্রাউনব্যাক বলেছেন, এখনো সহিংসতা চলছে। এ ছাড়া উত্তর কোরিয়ার পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। দেশটিতে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ২০ হাজার রাজনৈতিক বন্দির মধ্যে অনেকেই ধর্মীয় কারণে আটক বলে দাবি করা হয় প্রতিবেদনটিতে। চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের কথাও উল্লেখ করে তারা।
এদিকে, রাখাইনে হত্যা নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা সরেজমিন দেখতে সম্প্রতি কক্সবাজার শিবির পরিদর্শন করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের প্রতিনিধিদল। গত বছরের আগস্টে নির্যাতিত হয়ে ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে।
সফরে অন্যতম সদস্য যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি কারেন পিয়ার্স বলেন, ‘প্রতিনিধিদলের সদস্যরা একমত যে, গত এক দশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিশ্বের অন্যতম ঘটনা রোহিঙ্গা নির্যাতন। তিনি বলেন, নির্যাতিত, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু করা দরকার।’
নিজেদের উদ্যোগে লুকিয়ে গত বছরের শেষদিকে মিয়ারমারের রাখাইন রাজ্যের ভেতরে ঢুকে স্কাই টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান মার্টিন স্মিথ, প্রেডিওচার নেভিলি লাজারাস ও আমি যা দেখেছি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সব ঘটনা। দেখেছি স্থানীয়দের বাড়িঘর জালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ সীমান্তে ছুটে আসা অগণিত মানুষ বলেছে, ‘কীভাবে তাদের পেটানো হয়েছে, নারীদের গণহারে ধর্ষণ করা হয়েছে।’