ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হয়ে উঠে কমিয়ে দেয় রক্তের প্লাটিলেট। এ অবস্থায় রোগীর শরীরে দ্রুততার সঙ্গে নতুন রক্ত দিতে হয়। আক্রান্ত হওয়ার পর যাদের প্লাটিলেট কমেনি, তারাও নির্ভাবনায় থাকতে পারেন না। কারণ যে কোনো সময় হতে পারে সংকটময় পরিস্থিতি। তাদের জন্যও জোগাড় করে রাখতে হয় রক্ত। ফলে হাসপাতাল যখন ডেঙ্গু রোগীতে ভর্তি, তখন রক্তের জন্য হন্য হয়ে ছোটেন রোগীর স্বজনরা।
একসঙ্গে রক্তের এত বিপুল চাহিদা এর আগে কখনো দেখেনি ব্লাড ব্যাংকগুলোও। এর মধ্যে নেগেটিভ গ্রুপের রক্তের জন্য হাহাকার বেশি। ব্লাড ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, পজিটিভ গ্রুপের রক্ত যারা খুঁজছেন সেটা অনেকটা সহজেই দিতে পারছেন। কিন্তু নেগেটিভ গ্রুপের রক্ত তাদের কাছেও বেশি থাকে না।
তাই স্বজনদের হাসপাতালে ভর্তি করেই রক্তের জন্য শুরু হয় ছোটোছুটি। ফেসবুক খুললে নিয়মিত পোস্ট চোখে পড়ছে। কিন্তু এতেও কাজ হচ্ছে না, রক্ত পাওয়া যায় এমন প্রতিষ্ঠানগুলোতে করতে হয় যোগাযোগ।
সূত্র বলছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে রক্তের প্রয়োজন। এ চিন্তা থেকে রক্তদাতার সংখ্যাও কমেছে আগের তুলনায়।
ফলে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় গত দুই মাস ধরে রক্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর টেলিফোন ব্যস্ত থাকছে বেশি। দিন-রাত সেখানে লেগে আছে মানুষের ভিড়।
এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের থেকে এখন চার থেকে পাঁচগুণ বেশি মানুষ যোগাযোগ করছেন তাদের সঙ্গে। ২৪ ঘণ্টাই লেগে আছে ভিড়। কেউ নিচ্ছেন রক্ত, কেউ রক্তদাতাদের ফোন নম্বর নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকে দায়িত্বরত জাহিদুর রহমান বলেন, ‘আমাদের এখন প্রচণ্ড চাপ যাচ্ছে। অন্য বছরের তুলনায় এটা চার থেকে পাঁচ গুণ বলতে পারেন। অন্য সময় যেখানে মাসে দুই থেকে ৩০০ ব্যাগ প্লাটিলেট দিতে হতো জুলাই মাসেই সেখানে এক হাজার ৪০০ ব্যাগের মতো দেওয়া হয়েছে।’
কোয়ান্টাম ল্যাব, বাঁধন, সন্ধানীসহ যেসব প্রতিষ্ঠান রক্ত সরবারহ করে থাকে সবগুলোতেও একই চিত্র। ডেঙ্গু হলে অতিরিক্ত রক্ত ও প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয়। এক ব্যাগ সমপরিমাণ প্লাটিলেটের জন্য চার ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন।
ডোনার ম্যানেজ করতে পারেন না, এমন রোগীর স্বজনরা ভরসা করছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। প্রতিনিয়ত দেখা যাচ্ছে, অনেকেই নিজের মা, ভাই-বোন, সন্তানদের জন্য ডোনার খুঁজছেন। কেউ আবার পরিচিতজনদের জন্য রক্তের ডোনার খুঁজছেন।
রক্ত দিতে আগ্রহী অনেককে দেখা গেছে, নিজের রক্তের গ্রুপ ও মোবাইল নম্বরসহ ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। ডেঙ্গু রোগীদের কারো প্রয়োজন হলে যেন তাকে জানানো হয়।
আমিন আল রশীদ নামের একজন সাংবাদিক তার ওয়ালে পোস্টে বলেন, ‘আমার রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। ডেঙ্গু আক্রান্ত কারো রক্ত লাগলে বলবেন দৌড়ে চলে যাব।’
যমুনা টেলিভিশনের সাংবাদিক মীর মুশফিক আহসানও নিজের রক্তের গ্রুপ উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘আমার এবি পজেটিভ। ডেঙ্গু রোগীর জন্য রক্ত লাগলে ইনবক্সে জাস্ট বলবেন। রক্ত দিয়ে আসব।’
কোয়ান্টাম ল্যাবের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামুন হাসান বলেন, ‘আমাদের এখন অনেক চাপ যাচ্ছে। দিন-রাত রোগীর স্বজনরা আসছেন। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি রক্ত সরবারহ করার।’
প্রতিদিন কত ব্যাগ প্লাটিলেট সরবারহ করতে হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সময় হয়তো মাসে এক হাজার থেকে দেড় হাজার ব্যাগ প্লাটিলেট রক্ত সরবরাহ করতাম। কিন্তু জুলাইয়ের ২৭ তারিখ পর্যন্ত এ সংখ্যা তিন হাজার ৫০০ ছাড়িয়েছে। গত বছরও এই সময় হঠাৎ রক্তের চাহিদা বেড়েছিল।’
ফেসবুকভিত্তিক ‘ব্লাড ব্যাংক ০২০৪’ নিয়মিত স্বেচ্ছায় রক্তের ডোনারের ব্যবস্থা করে থাকে। গ্রুপের অ্যাডমিন ফাহমিদা সুপ্তি বলেন, ‘আগে প্রতিদিন যেখানে ২০ থেকে ২৫ জন ডোনার প্রয়োজন হতো। এখন প্রতিদিন ন্যূনতম ৬০ থেকে ৭০ জন ডোনার প্রয়োজন হচ্ছে রোগীকে রক্ত দেওয়ার জন্য। ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুর পর থেকে এই বাড়তি চাহিদা দেখা দিয়েছে।’
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন মানুষের শরীরে দুই লাখের ওপর প্লাটিলেট থাকা স্বাভাবিক। ২০ হাজারের নিচে নেমে গেলে সাধারণত রোগীকে পরামর্শ দেওয়া হয় প্লাটিলেট নেওয়ার জন্য। রক্তে প্লাটিলেট ধীরে ধীরে কমলে ভয়ের কারণ কম। তবে দেড় লাখ থেকে হঠাৎ ৫০ হাজার কিংবা ৮০ হাজার থেকে হঠাৎ ২০ হাজার- প্লাটিলেটের এমন পতন হলে তা ভয়ের কারণ হতে পারে।
প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেমন নাক বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তপাত, মলের সঙ্গে রক্ত আসে। তবে একবার প্লাটিলেট বাড়তে থাকলে, তা সাধারণত কমে না। অর্থাৎ ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে উন্নতির দিকেই যায় সাধারণত। যে কারণে ডেঙ্গু রোগীদের রক্তের প্লাটিলেট নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় থাকেন স্বজনরা।