প্রতিটি মায়ের জন্য তার সন্তানকে প্রথম কোলে তুলে নেওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তই বিশেষ। তবু মায়ের জন্য সবচেয়ে মানসিক প্রশান্তির মুহূর্তটি হলো যখন তিনি সন্তানকে বুকের দুধ পান করান। এর মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর মধ্যে একটি শক্তিশালী শারীরিক ও মানসিক সংযোগ তৈরি হয়। যদিও এখন অনেক মা-ই শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানোর বিষয়ে অনাগ্রহ দেখান। তাই জন্মের পর থেকেই অনেকে শিশুকে ফিডার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন। অথচ সাময়িক আরামের জন্য শিশুর যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে, সে বিষয়টি ভেবে দেখেন না।
১৯৯২ সাল থেকে ‘দি ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশনে’র উদ্যোগে এবং ইউনিসেফের সমর্থনে প্রতি বছরের ১-৭ আগস্ট পালিত হয়ে আসছে ‘মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’। সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য মাতৃদুগ্ধ কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে প্রায় দুই দশক ধরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে বিশ্বের ১৭০টি দেশে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়েছে ‘মায়ের দুধ পান সুস্থ জীবনের বুনিয়াদ’।
গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে নবজাতক মৃত্যুর হার ২২ শতাংশ কমানো সম্ভব। শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে বছরে ৩৭ হাজার নবজাতকের জীবন রক্ষা পাবে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জন্মের পর থেকে যেসব শিশু বিকল্প দুধ পান করেছে, মাতৃদুগ্ধ পানকারী শিশুর তুলনায় তাদের ডায়রিয়া ২৫ গুণ বেশি এবং শ্বসনতন্ত্রের ইনফেকশনে মৃত্যুর সম্ভাবনা চারগুণ বেশি। অন্য এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৪৩ শতাংশ নবজাতক জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পায়। অথচ জন্মের পর প্রথম ২৪ ঘণ্টায় প্রায় ৬০ হাজার নবজাতক বছরে মারা যায়। এ ছাড়া প্রতিবছর জন্মের পর প্রথম চার সপ্তাহের মধ্যে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার নবজাতক মারা যায়। এই ভয়াবহ চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, জন্মের পরপর শিশুর জন্য মায়ের দুধ কতটা জরুরি। সন্তান জন্মদানের পর প্রথম হলুদাভ ঘন যে দুধ আসে, একে শালদুধ বা কোলাস্ট্রাম বলে। পরিমাণে এটি অত্যন্ত কম হলেও নবজাতকের জন্য এটিই যথেষ্ট। শালদুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় রোগপ্রতিরোধক উপাদান ও শ্বেতকণিকা থাকে, যা নবজাতকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। শালদুধ পানে শিশুর অপরিণত অন্ত্র পরিপক্ব হয় এবং শিশুর পেটের মিকোনিয়াম বের করে দিতে সাহায্য করে, যা নবজাতকের পেটে থাকলে তা থেকে জন্ডিস হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিশুকে তাই বুকের দুধ খাওয়ানোয় কোনো অবহেলা করা যাবে না। পরিবারের সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। চাকরিজীবী থেকে শুরু করে গৃহিণী- প্রত্যেক মাকে তাদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যপারে আগ্রহী ও সচেতন করে তুলতে হবে।
মাতৃদুগ্ধ পানে শিশুর উপকারিতা
* মাতৃদুগ্ধ সন্তানের জন্য একটি সম্পূর্ণ খাবার। এতে শিশুর দেহের উপযোগী উপাদানগুলো যে পরিমাণে থাকে, তাতে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত অন্য কোনো খাবার এমনকি পানিরও প্রয়োজন হয় না।
* মায়ের দুধের সব উপাদান শিশুর দেহে সহজে হজম ও শোষিত হয়। ফলে এতে থাকা সব ধরনের ভিটামিন ও মিনারেল শিশুর দেহে সহজেই প্রবেশ করে।
* মাতৃদুগ্ধ শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
* জন্ম-পরবর্তী সময়ে নবজাতকের নানা ধরনের ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মায়ের বুকের দুধ পানকারী শিশুরা এ আশঙ্কা থেকে অনেকটাই মুক্ত থাকে।
* শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়।
* ভিটামিন ‘এ’ থাকার কারণে অন্ধত্ব দূর হয়।
* শরীরে ক্যালসিয়ামের শোষণ বাড়িয়ে দিয়ে হাড়ের গঠন মজবুত করে।
* বুকের দুধ খাওয়ার ফলে শিশুর মুখমণ্ডলের হাড় ও মাংসপেশি সুগঠিত হয়।
* মায়ের বুকের দুধে রয়েছে বিশেষ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা শিশুর বুদ্ধিদীপ্ততা ও চোখের জ্যোতি বাড়ায়।
* মায়ের দুধে প্রায় ১০০ উপাদান রয়েছে, যার প্রতিটি উপাদানই শিশুর জন্য একান্ত প্রয়োজনীয়।
সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো মায়ের জন্যও উপকারী
* সন্তান প্রসবের পরপর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হলে গর্ভফুল তাড়াতাড়ি পড়ে। এতে মায়ের জরায়ু খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যায় এবং প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত কম হয়। ফলে মায়ের রক্তস্বল্পতা দেখা দেয় না।
২. শিশুকে বুকের দুধ পান করান যেসব মা, তাদের স্তন ক্যানসার ও জরায়ু ক্যানসারের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
৩. ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো হলে শতকরা ৯৮ ভাগ ক্ষেত্রে তা জন্মনিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। অর্থাৎ প্রাকৃতিকভাবেই জন্মনিয়ন্ত্রণের কাজ করে। গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৭০ ভাগ মায়ের বাচ্চাকে দুধ পান করানো পর্যন্ত ঋতুস্রাব হয় না।
৪. সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মধ্য দিয়ে মা ও শিশুর মধ্যে একটি সুন্দর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিশু অনেক বেশি নিরাপদ বোধ করে।
৫. প্রসবের পরবর্তী আধঘণ্টার মধ্যে যারা শিশুকে বুকের দুধ দেন, তাদের দুধ তৈরি ও দুধ খাওয়াতে পরবর্তী সময়ে অসুবিধা কম হয় এবং তারা অনেকদিন পর্যন্ত বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারেন।
মায়ের দুধের বিকল্প দুধের অসুবিধা
* বিকল্প দুধ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের বোতলে করে খাওয়ানো হয়। আমরা জানি, প্লাস্টিক স্বাস্থ্যের জন্য কতখানি হানিকর। এ ছাড়া বোতলের নিপল এবং দুধ তৈরিতে ব্যবহূত পানির সঙ্গে রোগজীবাণু থাকার সম্ভাবনা তাকে। ফলে দেখা যায় শিশু ঘন ঘন অসুখে পড়ে।
* অনেক সময় শিশুকে একবারে বেশি দুধ বানিয়ে ফিডারে দেওয়া হয়। একবার খাওয়ার পর অবশিষ্ট দুধ পরবর্তী সময়ে আবারো খেতে দেওয়া হয়। গরমে বোতলে দুধ কিছুক্ষণ থাকলে তাতে খুব তাড়াতাড়ি রোগজীবাণু জন্মায়। বেশিরভাগ সময়ই তাড়াহুড়োর কারণে বোতল ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় না। ফলে এর থেকে শিশু নানা ধরনের অসুখে আক্রান্ত হয়।
* টিনজাত দুধ বা গরুর দুধে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকে। ফলে ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি বেড়ে যায়।
* বিকল্প দুধে লৌহ জাতীয় (আয়রন) পদার্থের অভাব থাকে বলে শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে।
* বুকের দুধ অপেক্ষা বিকল্প দুধের পুষ্টি উপাদানগুলো শিশুর শরীরে সহজে শোষিত হয় না। তাই দেখা যায়, অনেক পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে শিশু অপুষ্টির শিকার হয়।
* গরুর দুধ শিশুদের সহজে হজম হয় না। শিশু প্রায়ই কোষ্ঠকাঠিন্যে কষ্ট পায়। এ ছাড়া শিশুর পেট ফাঁপা থাকে।
* বিকল্প দুধের আরো একটি দৃশ্যমান অসুবিধা হলো, এটি ব্যয়বহুল। সঠিক নিয়মে খাওয়াতে হলে মাসে প্রচুর টাকা খরচ হয়। এতে করে অনেক মা-ই নির্দেশিত নিয়ম অনুযায়ী শিশুকে খাওয়ায় না। ফলে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি থেকে যায়।
* ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ক্ষেত্রে সন্তানের সঙ্গে মায়ের যে বন্ধন তৈরি হয়, অন্য উপায়ে বিকল্প দুধ খাওয়ালে সে বন্ধন তৈরি হয় না।
* খুব সহজে হজম হয় না বলে শিশুর বিভিন্ন ধরনের পেটের সমস্যা হতে দেখা যায়, যেমন- কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া।
শিশুর সুস্বাস্থ্য এবং রোগমুক্ত জীবনের জন্য মায়ের বুকের দুধের বিকল্প হতে পারে না। প্রতিটি মায়ের জন্য তাই শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো অত্যন্ত জরুরি।