নির্বাচনে পরাজয়বরণ করতে বরাবরই নারাজ ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে হুমকি-ধমকি থেকে শুরু করে নানা কূটকৌশল অবলম্বন করেছেন তিনি। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছিল না। নির্বাচনের ফল পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের শীর্ষ নির্বাচন কর্মকর্তাকেও চাপ দিয়েছেন ট্রাম্প।
তবুও হার মানতে রাজি নন তিনি। প্রয়োজনে রক্ত ঝরাতে হবে। হলোও তাই। গত বুধবার ক্যাপিটলে হামলা চালায় তার উগ্র সমর্থকরা। এতে প্রাণ হারান চারজন। ওই হামলা সারা বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের মাথানত করে দিয়েছে। এমনকী মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
কেন হামলা মোকাবিলার প্রস্তুতি ছিল না ওয়াশিংটনের নিরাপত্তা বাহিনীর? হামলার সময় ক্যাপিটল পুলিশের অস্ত্রপাতি কোথায় ছিল? কেন অন্য বাহিনীর সাহায্য নেওয়া হয়নি? গোয়েন্দারাই বা কেন আগেভাগে এসব আন্দাজ করতে পারেননি? মার্কিন প্রশাসন কী করছিল? বুধবার ক্যাপিটলে তাণ্ডবের পর এসব প্রশ্ন ঘুরপাঁক খাচ্ছে সবখানে।
মার্কিন নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ট্রাম্প সমর্থকদের এ হামলার ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চরম ব্যর্থতা বলে উল্লেখ করেছেন। তারা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্টের অভিষেকের মতো অনুষ্ঠানগুলোতে সাধারণত একাধিক নিরাপত্তা সংস্থার সমন্বিত পরিকল্পনা থাকে। গত বুধবার কংগ্রেসে জো বাইডেনকে জয়ী ঘোষণার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াতেও একই ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার কথা ছিল। অথচ ঘটনার দিন গোটা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ভার নিয়েছিল শুধু ক্যাপিটল পুলিশ। গোটা ১২৬ একর এলাকার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব ছিল এ বাহিনীর দুই হাজার সদস্যের হাতে। তার ওপর, হামলা শুরুর কয়েক ঘণ্টা পরেও ক্যাপিটল পুলিশের হাতে নিরাপত্তা সরঞ্জাম এসে পৌঁছায়নি।
ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিল থেকে হাঁটা দূরত্বে সমাবেশ করছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে সমর্থকদের সামনে তিনি আবারো জোর গলায় ঘোষণা দেন, যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর ভয়াবহ আঘাত করা হচ্ছে। এটি থামাতে সমর্থকদের ক্যাপিটলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে সরে যান ট্রাম্প। এর পরপরই পার্লামেন্ট ভবনে হামলে পড়ে তার কয়েক হাজার সমর্থক।
এ ধরনের ঘটনার আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল বেশ কিছুদিন থেকেই। এরপরও হোমল্যান্ড সিকিউরিটির মতো অন্য নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছে সহযোগিতার কোনো অনুরোধ জানায়নি ক্যাপিটল পুলিশ। এমনকী শহরের মেয়র ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের নামিয়েছেন হামলার এক ঘণ্টারও বেশি সময় পর। অথচ কিছুদিন আগে এই বাহিনীই বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনকারীদের কীভাবে দমন করেছিল, তা দেখেছে গোটা বিশ্ব।
এ ঘটনায় এখনো কোনো মন্তব্য করেনি ক্যাপিটল পুলিশ। মুখে কুলুপ এঁটেছে হোয়াইট হাউসও।
ক্যাপিটল পুলিশের সাবেক প্রধান টেরেন্স গেইনার বলেছেন, এ বাহিনীর সদস্যরা অনুপ্রবেশকারীদের ক্যাপিটল প্রাঙ্গণের বাইরে রাখতে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন। তবে ১৯ শতকের এই ভবনটিতে এত বেশি দরজা-জানালা রয়েছে, যা একসঙ্গে রক্ষা করা কঠিন।
গত বুধবার ট্রাম্প সমর্থকরা দেয়াল বেয়ে, দরজা-জানালা ভেঙে ক্যাপিটল ভবনে ঢুকে তাণ্ডব শুরু করে। কেউ সিনেটের প্রিজাইডিং কর্মকর্তার চেয়ারে, কেউ প্রতিনিধি পরিষদের প্রধান ন্যান্সি পেলোসির টেবিলে পা তুলে হাসিমুখে ছবি তুলছেন, কেউ অদ্ভুত পোশাক পরে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে বচসা করেছেন।
তাদের এই আক্রমণের মুখে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয় মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্সসহ সিনেট এবং প্রতিনিধি পরিষদের সদস্যদের। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজন মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এক নারী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে তাকে গুলি করার কারণ জানানো হয়নি। বাকি তিনজনের ক্ষেত্রে শুধু ‘জরুরি মেডিকেল পরিস্থিতি’ সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাইপ বোমা পাওয়া গেছে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির অফিস থেকে।
এ ঘটনার জন্য মার্কিন আইনপ্রণেতারা নিরাপত্তাবাহিনীর প্রস্তুতিহীনতাকে দায়ী করেছেন। টেক্সাসের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি ভিসেন্তে গঞ্জালেস বলেন, আমার মনে হয় পুলিশ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভালো কাজ করেছে। তবে এটা পরিষ্কার যে, তাদের যথেষ্ট পরিকল্পনা ছিল না।
কংগ্রেসের অনেক ডেমোক্র্যাট সদস্যই হামলার ব্যাপারে আগে থেকেই চিন্তিত ছিলেন। তারা সপ্তাহখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে সম্ভাব্য সহিংসতার বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন। তবে গোয়েন্দাদের কাছে রহস্যজনকভাবে এ ধরনের হামলা বা সেগুলো মোকাবিলা পরিকল্পনার কোনো তথ্যই ছিল না।
মার্কিন বিচার বিভাগের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সাধারণত বড় সমাবেশের ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ বা মাস ধরে পরিকল্পনা করে। স্থানীয় পুলিশ, ক্যাপিটল পুলিশ, সিক্রেট সার্ভিস, ফেডারেল পার্ক পুলিশের মতো বাহিনীগুলোর কর্মকর্তারা এফবিআইয়ের ওয়াশিংটন ফিল্ড অফিসে জড়ো হয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করেন। তবে গত বুধবারের অনুষ্ঠান ঘিরে এ ধরনের পরিকল্পনা কতটা ছিল, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে এ সাবেক কর্মকর্তার।
বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ক্যাপিটল ভবনে হামলা শুরু হলে তা মোকাবিলায় ঘটনাস্থলে ছিল শুধু ক্যাপিটল পুলিশ। তারা গোটা ভবনের দরজা-জানালা সুরক্ষিত রাখতে ব্যর্থ হন। সেগুলো ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে বিক্ষোভকারীরা।
ওয়াশিংটনের দুই কর্মকর্তা জানান, তারা আশা করেছিলেন, এ ধরনের সহিংসতা এড়াতে বিক্ষোভের আগেই হয়তো সামরিক জাতীয় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হামলার পর স্থানীয় পুলিশ সেখানে পৌঁছাতে কেন এত দেরি হলো, সেটিও পরিষ্কার নয়।
যেটাই হোক, নিরাপত্তা বাহিনীর বিলম্ব ছিল অনেক দীর্ঘ। মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ওয়াশিংটনের মেয়র স্থানীয় সময় দুপুর ২টায় ন্যাশনাল গার্ড বাহিনীকে ডাকেন। অথচ এর অন্তত ৪৫ মিনিট আগেই ক্যাপিটলের ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে পড়ে হামলাকারীরা। আর ভারপ্রাপ্ত মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ক্রিস মিলার ওয়াশিংটনের সব ন্যাশনাল গার্ড সদস্যদের সক্রিয় করেন দুপুর আড়াইটার পর।
বেশ কিছুদিন ধরেই এমন সহিংসতার আলামত দেখা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ওয়াশিংটনে অবৈধ বন্দুক নেওয়ার বিষয়ে কথা বলছিলেন। উগ্র ডানপন্থী সংগঠন প্রাউড বয়েসের নেতা এনরিক টারিও ঘোষণা দিয়েছিলেন, সম্মেলনে তাদের সদস্যরাও অংশ নেবে। গতমাসের একটি বিক্ষোভে আগ্নেয়াস্ত্রের ম্যাগাজিন সঙ্গে রাখার দায়ে গত সোমবার গ্রেপ্তার হন টারিও। পরে অবশ্য শহর ত্যাগের শর্তে ছাড়া পান তিনি।
প্রাউড বয়েস জানিয়েছে, সমাবেশে তাদের অন্তত ৬৫ জন সদস্য ছিলেন। তবে তারা ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে ঢুকেছিলেন কি না তা নিশ্চিত নয়। এছাড়া, টুইটারে গত ১ জানুয়ারি থেকে বিতর্কিত কিউঅ্যানন তত্ত্বের সমর্থকরা প্রায় দেড় হাজার টুইট করেছেন। সেখানে বুধবারের সমাবেশে সহিংসতার ইঙ্গিতপূর্ণ অনেক বার্তা ছিল। এমনকী টিকটকের একটি ভিডিওতে এক লোককে বলতে দেখা যায়, তারা ওয়াশিংটন যাচ্ছেনই শুধু বন্দুকের কারণে।
ক্যাপিটল পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা নিল ট্রুগম্যান হামলা প্রসঙ্গে বলেন, আমরা এমন এক ঘটনা দেখছি, যা কখনো কল্পনাও করিনি। এর জন্য তিনি সরাসরি ট্রাম্পকে দায়ী করে বলেন, এটা এখন আর শুধু বিক্ষোভ নেই। তারা সীমালঙ্ঘন করেছে। এটা সন্ত্রাস।
রয়টার্স