নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার
কয়েকদিন ধরে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিয়োগ বিধি সংশোধন করে বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবিতে গত ২৬ নভেম্বর থেকে স্বাস্থ্য পরিদর্শক, সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য সহকারীরা আন্দোলনে নেমেছে। যার ফলে ইপিআই কার্যক্রমসহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ হেলথ অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিদর্শক সমিতি, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় মাঠ কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন নামের সংগঠনের ডাকে এ কর্মবিরতি চলছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্যকর্মীরা যেসব কাজ করছেন, সেগুলো মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদি কিছু সমস্যার সমাধান শুরুতেই আটকে দিচ্ছে। তাদের কার্যক্রমের প্রভাব সরাসরি পরিলক্ষিত না হলেও মানবজীবনের বর্তমান প্রেক্ষাপটের শারীরিক সুস্থতার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো সামাল দিচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রব্যবস্থায় স্বাস্থ্য খাতে অধিক পরিমাণে ব্যয় করা সাধারণ জনগণের পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাছাড়া গ্রামের মানুষের পক্ষে সরকারের প্রদত্ত স্বাস্থ্যসেবার সুফল পাওয়া অত্যন্ত জটিল। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন এসব স্বাস্থ্যকর্মী। কিন্তু দীর্ঘদিনেও মাঠপর্যায়ে এদের দাবির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সরকার পক্ষের বারবার আশ্বাস কর্মচারীদের মনে বিরক্তির সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে এমন একটি প্রোগ্রামকে সামনে রেখে তারা এ কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন।
সম্প্রতি তাদের আন্দোলনের ফলে হাম-রুবেলার টিকা কর্মসূচির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হুমকির মুখে চলে এসেছে। ইতোমধ্যে এ টিকা দেওয়ার তারিখ বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এমনিতেই পৃথিবীজুড়ে আজ করোনা মহামারী, তার ওপর এই গুরুত্বপূর্ণ টিকা সফলভাবে সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে না পারলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে চলে যাবে। আর টিকার এসব কার্যক্রম মাঠপর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের হাতে বিকল্প এত পরিমাণে দক্ষ জনবলও নেই। সরকার ইতোমধ্যে এসব টিকা মাঠপর্যায়ে প্রদানের লক্ষ্যে বিকল্প হিসেবে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, নার্স, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, পরিবার কল্যাণ সহকারীদের ওপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মাঠপর্যায়ে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে বর্তমানে যাদের নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের অবস্থা বুঝে মনে হয় এটা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে এই কার্যক্রম এদের দ্বারা মাঠপর্যায়ে আদৌ কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তা সময়ই বলে দেবে। আর যদি হয়ও তাহলে দেখার বিষয় সরকারের চ্যালেঞ্জ কতটুকু সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়। আজকে দুপক্ষের যে অবস্থান, তাতে প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এ জায়গা থেকে সমাধানের পথে আসা দুরূহ কোনো ব্যাপার ছিল বলে মনে হয় না। আন্দোলনকারীরা দাবি করছেন ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর এক সমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস, ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবি মেনে নিয়ে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠন এবং এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সচিব দাবি মেনে নিয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব কাজের কোনো অগ্রগতি নেই।
মাঠপর্যায়ে গর্ভবতী মা ও শিশু নিবন্ধন করে ১০টি রোগের প্রতিষেধক টিকা, বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রদান, রোগ নিরীক্ষণ করে সন্দেহজনক রোগী বাছাই করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ, ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইন, কৃমি সপ্তাহ বাস্তবায়ন, হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন, এমনকি করোনার মতো ভয়াবহ ব্যাধিতে জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে এসব স্বাস্থ্যকর্মী। যার ফলে এমডিজি-৪ অর্জন, সাউথ সাউথ পুরস্কার, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ টিকাদানকারী দেশ, হাম-রুবেলা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পুরস্কার ও গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন অ্যান্ড ইমুনাইজেশন কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভ্যাকসিন হিরো সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। এসব পুরস্কারের অবদান সত্যিকার অর্থে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদান, এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। এদের কার্যক্রমের ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমে আসা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া ও পোলিওমুক্ত বাংলাদেশ, হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন সফলভাবে বাস্তবায়ন, যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, গুটিবসন্তমুক্ত, ধনুষ্টঙ্কারমুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব অর্জনের ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদানই মুখ্য। এমনকি করোনা মহামারীকালে মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা স্যাম্পল কালেকশন থেকে শুরু করে হোম কোয়ারেন্টাইনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাহলে তাদের অবদানকে আমরা কেন অস্বীকার করছি?
এদেরকে গ্রামীণ সাধারণ মানুষ ডাক্তার নামেই চেনে, এমনকি জনসাধারণ তাদের কাছ থেকেই চিকিৎসার প্রাথমিক সেবাটা পেয়ে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, তাদের এ ব্যাপারে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত নেই। স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠপর্যায়ের এতসব কাজ বাস্তবায়ন করার পরও তাদের নিয়োগ-বিধি সংশোধন করে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়নি। ২৬ হাজার কর্মচারীর এ পরিবারের প্রতি নজর আসছেই না। হাম-রুবেলার টিকা কোনোমতে বিকল্পদের দিয়ে দেওয়া গেলেও স্থায়ী কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটবে এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। দুপক্ষেরই সহনশীল অবস্থানে থেকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমাদের দেশে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেন সবকিছুতেই প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, সবকিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হয় তাহলে এতসব দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকের কী প্রয়োজন?
আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে, সঠিক কাজটাও সঠিক সময়ে করা যাচ্ছে না, যার ফলে সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আবার অনেক বিষয় আছে, যেগুলো প্রধানমন্ত্রীকে জানতেও দেওয়া হচ্ছে না বলে মনে হয়। মাঠকর্মীদের দাবি- পশু, কৃষি, মৎস্য বিভাগের যারা সেবা দিয়ে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগ দেওয়া হলেও মানুষের সেবা দেওয়ার মতো জটিল জায়গায় ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন যাবত হবে হবে বলা হলেও হচ্ছে না। অনেক দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ জেগে উঠেছে। টিকাদানে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীতে রোল মডেল, তারপরও মাঠপর্যায়ের কর্মীরা বঞ্চিত বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে। কে দেবে এদের প্রতি নজর?
লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী