মাছের দোকানের কর্মী রুবেল চায় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হতে

জাতীয় শিশু একাডেমিতে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে রুবেল

সংগৃহীত ছবি

শিক্ষা

মাছের দোকানের কর্মী রুবেল চায় বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হতে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর, ২০১৮

রুবেল হোসেন। বয়স ১২ বছর। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। সে এডুকো ওয়ার্কিং চিলড্রেন স্কুল বাঁশবাড়ীর ছাত্র। ওর বাবা রাজমিস্ত্রী। মা সংসার সামলান। রুবেলরা সংসারে পাঁচজন মানুষ। বাস করছে বস্তির একটি খুঁপড়িঘরে। তিন ভাই বোনের মধ্যে রুবেল দ্বিতীয়। পরিবারের প্রয়োজনেই তাকে কাজ করতে হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত কাজ, তারপর স্কুল, স্কুল শেষে আবার কাজ।

কাজ করে পরিবারকে সহায়তা করা, কাজের ফাঁকে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া তার জন্য কঠিন। কিন্তু অদম্য রুবেল হাল ছাড়ার ছেলে নয়। চিত্র অংকনে তার দারুণ আগ্রহ। আঁকার হাতও বেশ। অবসর পেলেই সে আঁকে। তবে কোনো শিক্ষকের কাছে আঁকিবুকি শেখার সুযোগ হয়নি। এবার যখন জাতীয় শিশু একাডেমিতে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয় তার স্কুল থেকে তাকে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়। হাজার হাজার প্রতিযোগীকে পিছে ফেলে সে দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। হাতে পুরস্কার পেয়ে রুবেল অনেক খুশী। সে আগের চেয়ে অনেক সাহসী। সে বলল, ‘আমি সবার মতই পারি, তা এখন বুঝতে পারছি।’

রুবেল মাছের দোকানে কাজ করে। এর আগে সে লেগুনার হেলপার ছিলো। সেখান থেকে মাসে চার হাজার টাকা রোজগার হয়। রোজগারের সব টাকা মায়ের হাতে তুলে দেয়। কোনো জড়তা ছাড়াই রুবেল বলল, ‘প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির সময় আমার বয়স নির্ধারিত বয়সের চেয়ে বেশি ছিল। সম্পূর্ণ বিনাখরচে এডুকো ওয়ার্কিং চিলড্রেন স্কুল বাঁশবাড়ীতে লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়ে আমি খুব খুশি। আমি বড় হয়ে একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হতে চাই। গরীবদের কথা ছবিতে তুলে ধরতে চাই।’ এই হলো রুবেলের জীবনের গল্প আর প্রত্যাশা।

বাংলাদেশে রুবেলের মতন সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত। আর ১ লাখ ২০ হাজার শিশু শ্রমিক রয়েছে, এর অধিকাংশই সুমাইয়ার মতো শিশু যারা যৌন নির্যাতনসহ নানা ধরনের ঝুঁকিতে থাকে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের মধ্যেও রুবেলরা জীবনে সুন্দর স্বপ্ন দেখে। চিত্রশিল্পী, ডাক্তার, পাইলট, শিক্ষক বা বড় কর্মকর্তা হতে চায় তারা। ওরা নিজের পরিবার, সমাজ বা দেশের জন্য অবদান রাখতে চেষ্টার কমতি রাখে না। কিন্তু তারা কি পারে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে, সমান সুযোগ ও অধিকারের সঙ্গে সম্মানজনক জীবনযাপন করতে?

এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এডুকো) আন্তর্জাতিক একটি উন্নয়ন সংস্থা। এডুকোর প্রজেক্ট অফিসার (প্রোগ্রাম অপারেশন) মো. কবির হোসেন বলেন, ‘এডুকো এমন এক বিশ্ব দেখতে চায় যেখানে সব শিশু তাদের অধিকার পুরোপুরি ভোগ করবে এবং একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করবে। শিশু এবং কমিউনিটির সঙ্গে কাজ করে ন্যায় ও সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করা যাতে তাদের অধিকার ও কল্যাণের নিশ্চয়তা থাকে। এডুকো ঢাকা শহরের বস্তিতে পাঁচটি কর্মজীবী শিশুদের বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছে। এই স্কুলগুলোর মাধ্যমে বর্তমানে সুমাইয়ার মতো প্রায় ৯৫৬ জন শিশু সরাসরি শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারছে।’

এডুকো ২০০১ সাল থেকে ঢাকা শহরের শ্রমজীবী শিশুদের লেখাপড়ার জন্য ওয়ার্কিং চিলড্রেন স্কুল পরিচালনা করে আসছে। এডুকো বাংলাদেশ মনে করে ‘শহরাঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম হ্রাসকরণ’ প্রকল্পের অধীনে গৃহীত কর্মকান্ডের মাধ্যমে শুধু ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নয় বরং অন্যান্য সব শিশুশ্রম এবং অপব্যবহার থেকে শিশুদের বিরত রাখতে এবং শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত কল্পে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত স্কুলগুলো ঢাকার হাজারিবাগ, বাঁশবাড়ি, শ্যামপুর, কড়াইলবস্তি এলাকায় অবস্থিত। এ পর্যন্ত প্রায় ৮০১১ জন কর্মজীবি শিশুর জীবনে আলোর পথ দেখাতে সক্ষম হয়েছে এডুকো বাংলাদেশ। দেখা গেছে যে, এডুকো পরিচালিত বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কর্মজীবী শিশুদের অধিকাংশই নানা রকম ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলো। এই ধরনের কাজের মধ্যে কেউ কেউ অটোমোবাইল ওয়ার্কশপ (গাড়ীর গ্যারেজ, মটরসাইকেল) ব্যাটারি রিচার্জ করার দোকান, বিড়ি সিগারেট কারখানায়, ইট-পাথর ভাঙ্গা, ইঞ্জিনিয়ারিং লেদার মেশিনের কাজ, প্লাস্টিক রাবার কারখানায় (জুতা, সেন্ডেল), স্টিল-মেটাল ফার্নিচার, কাঠের ফার্নিচারের রঙের কাজ, ট্যানারি ও চামড়া শিল্প কারখানায়, ভাঙ্গারির দোকান, টেম্পু বা বাসের হেলপার, হোটেলে বাসনকোসন ধোয়া, মুদির দোকান, সাপ্লাইয়ের কাজ, বাসাবাড়ির কাজসহ নানা ধরনের কাজে নিয়োজিত।

শিশু অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের অর্জনগুলো আলোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৯০ সালের ২৬ জানুয়ারী প্রথম দিনেই যেসব রাষ্ট্র এতে স্বাক্ষর দান করে বাংলাদেশ তাদের অন্যতম। ১৯৯০ সালের ৩ আগস্ট বাংলাদেশ এই সনদে অনুসমর্থন (রেটিফিকেশন) দান করে, অর্থাৎ সনদের বাস্তবায়নে রাষ্ট্রের অঙ্গীকার গ্রহণ করে। বাংলাদেশ সরকার সেই থেকেই শিশু অধিকারের বিষয়সমূহ এদেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের সাথে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা ও এর বাস্তবায়ন করে আসছে।

এখানে শিশু অধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের অর্জনসমূহের কিছুটা আলোকপাত করা হলো :

বাংলাদেশ সরকার চলতি জুলাই ৪-৬, ২০১৮, ২৬টি মন্ত্রনালয় নিয়ে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) বাস্তবায়ন বিষয়ক কর্মশালা সম্পন্ন করা। বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাসমূহ সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সাথে সমন্বয় রেখে একটি হ্যান্ডবুক তৈরী করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা তথ্য অসম্পন্নতা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বিগত মার্চ ২০১৮ তে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়সমূহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা সুচক অনুযায়ী বেইজ লাইন ডাটা ও ডাটার উৎস চিহ্নিত করেছেন এবং সরকার শিশু অধিকার ও শিশু সুরক্ষা বিষয়ক কিছু নীতিমালা, আইন ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন আর ২০২১ সালের মধ্যে সব শিশুশ্রম বন্ধের অঙ্গীকার রয়েছে।

কবির হোসেন বলেন, এই প্রত্যাশা করতে পারি, সরকারের গৃহীত সব উন্নয়ন পরিকল্পনা, উন্নয়ন সংস্থাগুলোর সমন্বিত কর্মকান্ড বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুদের জন্য এমন একটি পরিবেশ নিশ্চিত হবে যেখানে থাকবে না কোনো ধরনের বৈষম্য। শিশুরা সব ধরনের অধিকার পুরোপুরি ভোগ করবে আর রুবেলদের মতো শ্রমজীবী শিশুরাও সম্মানজনক জীবনযাপন করবে। আর রুবেলদের একেকটি সফলতার মাধ্যমেই গড়ে উঠবে জ্ঞানভিত্তিক, উন্নত ও সমৃদ্ধশালী আগামীর বাংলাদেশ।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads