মজুরিবৈষম্য চান না মধুপুরের গারো-কোচ নারীরা

এভাবেই দিনভর ফসলি জমিতে কাজ করেন গারো ও কোচ নারীরা

ছবি-হাবিবুর রহমান

ফিচার

মজুরিবৈষম্য চান না মধুপুরের গারো-কোচ নারীরা

  • প্রকাশিত ৫ অগাস্ট, ২০১৮

হাবিবুর রহমান, মধুপুর

নির্মলা নকরেক। বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি গারো পল্লীর মধুপুরের সাইনামারী গ্রামে। সাইনামারী গ্রামে আছে আনারস বাগান, কলার বাগান, আছে কৃষি ফসল করার মতো অনেক সুযোগ ও জমি। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কাঁচি, ছেনি, দা, কোদাল নিয়ে পুরুষের মতো কাজের সন্ধানে বের হন নির্মলা নকরেক। একই জমিতে একই সঙ্গে পুরুষও কাজ করে। সেখানে পুরুষের মজুরি ৩০০ টাকা আর তার মজুরি ২০০ থেকে আড়াইশ’ টাকা। মজুরিবৈষম্যের ব্যাপারে নির্মলা জানান, নারী বলে তাদের মজুরি কম দেওয়া হয়। কাজ সমান করলেও মজুরি সমান পান না। একই গ্রামের লোপিয়া ম্রং (৩৫)। স্বামী, ২ ছেলে ও মেয়ে নিয়ে তার সংসার। তিনি মজুরি ভিত্তিতে মাঠে দিনমজুরের কাজ করেন। তার মজুরি দৈনিক ২৫০ টাকা। স্বামীর মজুরি ৩০০ টাকা। দুজনে যে মজুরি পান তা দিয়ে চাল-ডাল কিনে খান। অভাবের সংসার, নিত্যদিন কাজ করতে হয়। কাজ না করলে খাদ্যের জোগান হয় না। এভাবে একই গ্রামের প্রেনিতা নকরেক (৪৫), লাবনী চিরান (৩০), সোমা মৃ (৪৫), রাজঘাটি গ্রামের চন্দ্রা নকরেক (৫০), ববিতা নকরেক (৩৫), সেলিনা দালবত (৪৮) জানান, তাদের জমি ছিল। অভাবের কারণে কেউ জমি লিজ দিয়েছেন। কেউবা বিক্রি করেছেন। এভাবে জমিজমা হারিয়ে তারা দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। অভাব-অনটনের কারণে অন্যের জমিতে এখন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় গারো নারীরা কৃষিকাজে ব্যাপক শ্রম ঘাম দিয়ে থাকে। কৃষিকাজে রয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা। সমানতালে পুরুষের সঙ্গে কাজ করেন। ধান কাটা, চারা রোপণ, জমি নিড়ানি, ফসল কাটা, কলাবাগানের পরিচর্যা, আনারস বাগানে কাজসহ গৃহস্থালির নানা কাজে তারা পারদর্শী। তারা জানান, মধুপুর গড় এলাকায় গারো নারীরা কৃষিকাজে অনেকটা এগিয়ে। কলাবাগানের কাজে রয়েছে তাদের ব্যাপক পারদর্শিতা। দক্ষতা রেখেছেন কৃষিকাজেও। গড় এলাকায় কৃষিকাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের হাতে ফলছে সোনার ফসল। নির্মলা নকরেক, লোপিয়া ম্রং, প্রেনিতা নকরেক, লাবনী চিরান, সান্ত্বনা চিরান, সোমা মৃ, ববিতা নকরেক ও সেলিনা দালবতই নয়- তাদের মতো মধুপুর গড় এলাকা চাপাইদ, সাইনামারী, নয়নপুর, কোনাবাড়ী, ধরাটি, মমিনপুর, দোখলা, পীরগাছা, বেদুরিয়া, কাকড়াগুনি, জালাবাদা, জয়নাগাছা, গায়রা, জাঙ্গালিয়া, বেরিবাইদ, মাগন্তিনগর, গেৎচুয়া, টেলকিসহ প্রায় ৫০টি গ্রামে নৃ-গোষ্ঠীর গারো কোচ নারীরা কৃষিকাজে দিনমজুরের কাজ করে থাকে। কাজে আছে অফুরন্ত শ্রম ও মেধা। তবু রয়েছে তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার কর্মনিষ্ঠা।

জীবন-জীবিকার জন্য কাকডাকা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্রম দিয়ে গড় এলাকার কৃষি ফসলের মাঠকে পরিণত করছেন সোনায়। প্রতিদিন রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাঠে কাজ করতে যান। দিনশেষে প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে আহারের ব্যবস্থা করেন। এভাবেই চলছে গড় এলাকার নৃ-গোষ্ঠী পরিবারগুলো কয়েক হাজার গারো-কোচ নারীর জীবন-জীবিকা ও পথচলা। তাদের শ্রমের স্বীকৃতি পেলে তারা ন্যায্য মজুরি পাবেন এমনটাই তাদের আশা।

পীরগাছা কোচপল্লীর সুমিত্রা রানী কোচ (৪৮) ধানের জমিতে নিড়ানির কাজের ফাঁকে বলেন, অন্যের কাজ করি। তার মতে, স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে কাজ করে উচ্চমূল্যের বাজারে সবকিছু কিনে খেতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। রূপালী রানী (৪০) জানান, ছেলেমেয়েদের যাতে এ কাজ করতে না হয়, সেজন্য পড়াশোনায় দিয়েছেন। শত কষ্ট স্বীকার করে সকালে রান্নাবান্না করে ছেলেমেয়ের খাইয়ে তারপর তারা মাঠে ছোটেন কাজের সন্ধানে। মজুরি ছাড়া যখন চুক্তি ভিত্তিতে কাজ করেন, তখন তারা পুরুষের সমান মজুরি পান। তবে চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ কম। ফলে তাদের দৈনিক মজুরিতে কাজ করতে হয়।

এ ব্যাপারে মধুপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান নারী নেত্রী যষ্ঠিনা নকরেক জানান, নারীরা সকালে বাড়ির কাজ করে মাঠের কাজও করে। তারপরও মজুরিবৈষম্য ও সামাজিক মর্যাদায় এখনো নারীরা পিছিয়ে আছে। তিনি নারী উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি সংগঠনকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা ম্রং জানান, নারীরা ঘর থেকে মাঠ পর্যন্ত কাজ করে। মাঠে যেখানে পুরুষ শ্রমিকের বেতন ৩-৪শ’ টাকা, সেখানে একজন নারী শ্রমিকের মজুরি ২ থেকে ২৫০ টাকা। কাজ সমান করলেও মজুরিবৈষম্য রয়েছে। পিছিয়ে আছে গ্রামীণ নারীরা। তাদের এগিয়ে নিতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads