পণ্যবাজার

ভোজ্যতেলের দাম আকাশছোঁয়া

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১৯ জানুয়ারি, ২০২১

নিত্যপ্রয়োজনীয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সয়াবিন তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। রোববার রাজধানীর খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৩৫-১৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে। গত ৩ থেকে ৪ মাসে সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৫৫-৬০ শতাংশ। করোনা মহামারীর কারণে বিশ্বে পাম অয়েলের উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও বর্তমানে খোলা তেলে মণপ্রতি ৩০০-৪০০ কমেছে বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পাইকারী ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘খোলা তেলে প্রতি মণে ৩০০-৪০০ টাকা দাম কমেছে। আগে যে তেল ৪ হাজার ৫০০ টাকা মণ ছিল সেটি বর্তমানে ৪০০০-৪২০০ এর মধ্যে নেমে এসেছে।’ তবে পাইকারী বাজারে প্রভাব এখনো খুচরা বাজারে পড়েনি। ব্যবসায়ীরা জানান, খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশি মূল্যে কেনা তেল শেষ হলেই দাম কমে আসবে। কিন্তু যে পরিমাণ দাম কমবে তাতে বর্তমান মূল্যের খুব বেশি হেরফের হবে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। এ অবস্থায় ভোজ্যতেলের মূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানতে হলে আমদানি শুল্ক কমানোর বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে ভোজ্যতেলে তিন স্তরের ভ্যাটের পরিবর্তে এক স্তরের ভ্যাট নির্ধারণের জন্য চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি বিবেচনার জন্য সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) এ ব্যাপারে একটি চিঠি দিয়েছে। চলতি মাসের শেষে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীদের নিয়ে বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘দেশের  ভোজ্যতেল শতভাগ আমদানিনির্ভর। আর ভোজ্যতেল আমদানি করে থাকে ৬টি প্রতিষ্ঠান। এদের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই কারো। তারা যা বলে তাই সবাইকে মেনে নিতে হয়। বিশ্ববাজারে বর্তমানে তেলের দাম বেশি থাকায় সয়াবিনের দাম বেড়েছে বলে জানিয়েছে এসব কোম্পানি। এ কারণে তারা দাম কমালে আমরাও কমাতে পারব। গোলাম মাওলা বলেন, ভোজ্যতেলের দাম কমাতে হলে ট্যাক্স তুলে দিতে হবে। তিনি বলেন, প্রতি লিটার তেলে ৩ স্তরে ১৮ টাকা ভ্যাট দিতে হয়। ট্যাক্স তুলে দিলে অন্তত লিটার প্রতি ১৮ কমে আসবে  ভোজ্যতেলে।’

বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের গত বছরের ৩০ নভেম্বর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ আমদানি পর্যায়ে ১৫% ও ৫% এবং উৎপাদন পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫% হারে ভ্যাট ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫% অথবা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্যের ওপর ৫% হারে ভ্যাট প্রদান করে থাকে। ভোজ্যতেল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিবেচনায় বিদ্যমান ভ্যাট আহরণ পদ্ধতিতে অত্যাবশ্যকীয় এ পণ্যটির মূল্য স্থিতিশীল রাখা কঠিন, কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত ভোজ্যতেলের মূল্য প্রতিনিয়ত ওঠানামা করে। এ ওঠানামার ফলে বর্তমান পদ্ধতিতে সরকারকে প্রদেয় ভ্যাটের অংশও পরিবর্তিত হয়। এ ছাড়া সরবরাহকারী ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট সমন্বয় করা অত্যন্ত কঠিন। কারণ সরবরাহ ও খুচরা ব্যবসায়ী পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা যথাযথ হিসাব সংরক্ষণ না করায় মূল্য সংযোজনের ওপর ১৫% ভ্যাট না দিয়ে রেয়াতি হারে ৫% হারে ভ্যাট প্রদান করছে যা মূল্য সংযোজন অপেক্ষা অনেক বেশি। ফলে ভোজ্যতেলের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নিয়োগকৃত অনেক সরবরাহকারী তাদের কাছ থেকে পণ্য নিতে আগ্রহ হারাচ্ছে।   

বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রস্তাব বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন কর্তৃক পর্যালোচনা করার পর ভোজ্যতেলের আমদানি, উৎপাদন ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে আরোপিত ভ্যাট অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে শুধু আমদানি পর্যায়ে প্রতি মে. টনে ১৬ হাজার টাকা নির্ধারণের মতামত দেয়। ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সাধারণত ৮ লক্ষ মে. টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও ১২ লক্ষ মে. টন পরিশোধিত/অপরিশোধিত পাম তেল আমদানি করা হয়। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের ৩০% বোতলজাত করে বাজারজাত করা হয়। অন্যদিকে অপরিশোধিত পামতেল/অলিনের ১০% বোতলজাত করে বাজারজাত করা হয়।

শুধু বাংলাদেশেই নয়, দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে বিশ্বজুড়েই। টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন বলছে, গেল নভেম্বর পর্যন্ত ভারতে ভোজ্যতেলের দাম ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। চীনা গণমাধ্যম নিক্কেই এশিয়ার তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারীর কারণে ইন্দোনেশিয়ায় ২০২০ সালের প্রথম ৬ মাসে পাম অয়েল রপ্তানি কমেছে ১৫.৫ মিলিয়ন টন যা শতকরা হিসেবে ১১ শতাংশ। একইভাবে মালেয়শিয়াতেও গত বছর আগস্ট পর্যন্ত ৫ শতাংশ রপ্তানি কমেছে। দেশ দুটি বিশ্বে চাহিদার ৯০ শতাংশ জোগান দিয়ে থাকে। এর মধ্যে ভারত এবং চীনও দেশটি থেকে বিপুল পরিমাণ পাম অয়েল আমদানি করে থাকে। টাইমস্ অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বিশ্বের আমদানিকারক দেশগুলোর মধ্যে একা ভারত ১৯ শতাংশ এবং চীন আমদানি করে ১৩ শতাংশ পাম অয়েল আমদানি করেছে। চাহিদা বিবেচনায় উৎপাদন ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় বেড়েছে এই ভোগ্য পণ্যটির দাম।

অয়েল ওয়ার্ল্ডের তথ্য বলছে, গত বছর দেশে অপরিশোধিত পাম অয়েল আমদানি হয়েছে ১৫ লাখ ৬০ হাজার টন। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ২০ হাজার টন। অন্যদিকে গত বছর দেশে মোট ৮ লাখ ৪০ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। এর আগের বছর পণ্যটির আমদানির পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮০ হাজার টন। এর বিপরীতে ২০১৯ সালে দেশে ১৫ লাখ ৯০ হাজার টন সয়াবিন তেলবীজ আমদানি হয়েছে। ২০১৮ সালে  ১৩ লাখ ৫০ হাজার টন সয়াবিন তেলবীজ আমদানি হয়েছিল। ২০১৮ সালে দেশে ৪ লাখ ৩০ হাজার টন সরিষা তেলবীজ আমদানি হয়েছিল। গত বছর এর পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৬০ হাজার টনে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউয়ে বলা হয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভোজ্যতেল আমদানিতে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ১১৬ কোটি ১০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১৮৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। তেলবীজ আমদানিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪০ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় হয়েছে। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৫৭ কোটি ১০ লাখ ডলার।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads