এমদাদুল হক বাদল
কুকুর নিয়ে বেশ ক’দিন ধরে পত্র-পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম। কেউ কেউ নাকি রিটও করেছেন। প্রথমেই বলে নেই বেওয়ারিশ কুকুর সরাতে হবে ভালো, কিন্তু নিধন করতে হবে—বিষয়টি মেনে নেওয়া কষ্টকর। কুকুরপ্রেমি মানুষ সমাজে প্রচুর আছে, প্রাণিপ্রেমি এমনকি মানুষপ্রেমিও আছে প্রচুর। আশার কথা, ভালো কথা। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যাদের দৌড় শুধু খিস্তি-খেউড় পর্যন্ত! কুকুর সরানোর প্রতিবাদে সরব, কিন্তু দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। রাস্তার কুকুরকে একটু আদর দেখিয়ে, সামান্য কিছু খাবার দিয়ে রাস্তায়ই রেখে দিলেন! আর সেই কুকুরই রাস্তায় চলাচলকারী পথচারী সাধারণ মানুষকে কামড়ে দিচ্ছে, স্কুলগামী বাচ্চাদের তাড়াচ্ছে। যাকে কামড়েছে তার ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা হলো কিনা, দিনমজুর হলে তার পরিবারের সাময়িক ভরণপোষণ হলো কিনা—এসব দেখার কয়জন আছে সমাজে?
রাজশাহীর দূর্গাপুরে ব্র্যাক অফিসে থাকাকালীন দুটি বেওয়ারিশ কুকুর এসে নিজেদের মতো করে সেখানে থাকা শুরু করলো। আমরাও মহাউৎসাহে তাদের আদর দিয়ে পোষ মানিয়ে ফেললাম। আমরা ওদের ভ্যাকসিনও দিয়ে নিলাম। দুদিন পর পর বাবুর্চিকে দিয়ে গোসল করিয়ে নিতাম। সাধারণত ওরা আবাসিক এলাকার বাইরে যেত না। পুরুষটা (লালু) খায়-দায় আর সারাদিন ঘুমায়। মেয়ে কুকুরটা (কালু) বেশি বিশ্বস্ততা দেখাতে গিয়ে অফিস স্টাফ ছাড়া অন্য কাউকে আবাসিক এলাকার মধ্যে ঢুকতে দিত না। লুঙ্গি পরা কাউকে ঢুকতে দেখলেই পেছন থেকে গিয়ে কামড়ে দিত। দিনে দিনে অভিযোগ বাড়তে থাকে। এভাবে সে একে একে ১১ জনকে কামড়ে দেয়। একপর্যায়ে কোনো এক সকালবেলা এলাকার লোকজন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে অফিসে হাজির। কুকুর তাদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। সঙ্গে জরিমানা ভ্যাকসিনের টাকাসহ।
লালু আর কালুকে হারিয়ে সেদিন ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলাম। আসলে ওদের সন্তানের মতোই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ওদের উপর প্রতিটা লাঠির আঘাত মনে হয়েছিল আমার বুকে এসে লেগেছিল। আজো লাগে স্মরণে এলে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না তখন। ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ভ্রে রাস্তায় কোনো বেওয়ারিশ কুকুর নেই বললেই চলে। আপনার ইচ্ছে হলে বাড়িতে পোষেণ। আমাদের দেশে রাস্তায় জন্ম নেওয়া বেশিরভাগ কুকুরের বাচ্চা না খেয়ে মারা যায়, গাড়ির চাকার নিচে পিষ্ট হয়। কেউ কেউ যুক্তি দেখাচ্ছেন, ওরা রাস্তায় ফেলা ময়লা বাসি-পচা খাবার খেয়ে পরিবেশ ভালো রাখে। মানুষ হয়ে যেসব অমানুষ রাস্তায় ময়লা ফেলে, তাদের এ কাজ থেকে বিরত রাখা কি আরো জরুরি নয়? যত্রতত্র ময়লা ফেলা, থুথু ফেলা, কাঁশি-কফ ফেলার বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। এখানে তরুণরা এগিয়ে এলে সফলতা লাভ সম্ভব।
প্রকাশিত সংবাদ মতে, ঢাকা শহরে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা আনুমানিক ৩০,০০০। যা একেবারে কম নয়। নিজেদের এলাকার দখল নিয়ে নিজেদের মধ্যে যখন মারামারি, উন্মত্ত ছোটাছুটি করে তখন আশপাশের পথচারী মহিলা, শিশু, বৃদ্ধ সবাই আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বেওয়ারিশ কুকুর নিধনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পরবর্তীকালে অ্যানিমেল রাইটস গ্রুপের সুপারিশ ও পরামর্শ মতে, কুকুর বন্ধ্যাকরণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কিন্তু তা অকার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকার বাইরে নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। আর এতেই বাঁধ সাধেন কুকুরপ্রেমি জনগণ।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ রাস্তার কুকুর । যখন আড়াআড়ি দৌড় দেয়, মোটর সাইকেল এবং আরোহীসহ অন্য যানবাহনের ড্রাইভারদের তখন কিছুই করার থাকে না। অনেক সময় কুকুর বাঁচাতে নিজেরাই দুর্ঘটনার শিকার হয়। এছাড়া উপদ্রব সৃষ্টিসহ রাতের বেলা বাসিন্দাদের জাগ্রত করে, আবর্জনা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পরিবেশ বিঘ্নিত করে। জনমনে জলাতংক রোগ সম্পর্কেও একটা ভীতির জন্ম নেয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৫২টি বেওয়ারিশ কুকুরের বাস। সারাদেশের চিত্র এখানে প্রতিফলিত হয়নি, কারণ দেশব্যাপী জরিপও চালানো হয়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে যে, বাংলাদেশে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বেওয়ারিশ কুকুর আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃৃথিবীতে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা প্রায় ২০০ মিলিয়ন। বর্তমানে সারাদেশে কুকুরের কামড়জনিত র্যাবিস রোগে বছরে প্রায় দুই সহস্রাধিক লোক মৃত্যুবরণ করে। সুতরাং কুকুরের প্রতি ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো এড়িয়ে যাওয়া সমীচীন নয়। তবে বাংলাদেশের সব বেওয়ারিশ কুকুরের কামড়েই জলাতংক রোগ হয় না। মাত্র ৬% কুকুর জলাতংক রোগের জীবাণু বহন করে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে আশার কথা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের মধ্যে জলাতংক রোগ নির্মূল প্রকল্পের অংশ হিসেবে প্রায় ৭০% বেওয়ারিশ কুকুরকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হয়েছে।
জাতীয় সংসদে ‘Cruelty to Animals Act 1920’-এর পরিবর্তন, পরিমার্জন সাপেক্ষে নতুন নামে ‘Animal Protection Act 2019’ পাস হয়েছে। এতে প্রাণীদের উপর নিষ্ঠুরতার যেমন বিস্তারিত সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তেমনি অপরাধভেদে শাস্তির মাত্রাও বাড়ানো হয়েছে। এই আইনটি প্রাণীদের উপর সদয় আচরণের প্রয়োজনীয়তার একটি দলিল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই আইনের সপ্তম ধারায় বেওয়ারিশ কোনো প্রাণী হত্যার অনুমতি দেয় না, যদি না তারা কোনো ক্ষতির কারণ হিসেবে প্রমাণিত হয়।
পুনশ্চ : রাস্তার কুকুরকে গালের কাছে নিয়ে চুমু খাওয়া যতটা সহজ, কুকুরের সঙ্গে ছবি তোলা যত সহজ, ঐ কুকুরের দায়িত্ব নেওয়া অতটা সহজ না। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী সম্প্রতি বেশ কজন প্রাণিপ্রেমিকে ১/২টি করে রাস্তার কুকুরের দায়িত্ব নিতে দেখা গেছে। যা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। সবাই এভাবে এগিয়ে এলে বেওয়ারিশ কুকুর রাস্তায় থাকবে না আশা করি। সেই সঙ্গে কুকুরের প্রতি অমানবিক আচরণ যেমন দূর হবে, তেমনি কুকুরের কারণে জনভোগান্তিও দূর হবে।
লেখক : সাংবাদিক