বিলুপ্তির পথে দিনাজপুরের তাঁতশিল্প

দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প

সংরক্ষিত ছবি

ফিচার

ঋণের দায়ে অনেকের ভিটেমাটি নিলামে

বিলুপ্তির পথে দিনাজপুরের তাঁতশিল্প

  • দিনাজপুর প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৪ জুলাই, ২০১৮

নানা সমস্যায় জর্জরিত দিনাজপুরের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলার মধ্যে ৮টি উপজেলায় তাঁতের শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল। উপজেলাগুলো হচ্ছে চিরিরবন্দর, পার্বতীপুর, কাহারোল, ফুলবাড়ী, খানসামা, বীরগঞ্জ, সদর ও বোচাগঞ্জ উপজেলা। এসব উপজেলার বেশকিছু এলাকায় তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছিল। এর মধ্যে আবার চিরিরবন্দর উপজেলার রানীরবন্দর অঞ্চলেই জেলার ৭৫ থেকে ৮০ ভাগ তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছিল। দেশ স্বাধীনের পর মূলত এ অঞ্চলের কাপড়ের চাহিদা মেটানোর জন্য সরকারি উদ্যোগে এসব তাঁতশিল্প গড়ে উঠেছিল। তখন থেকেই এ অঞ্চলে তাঁতশিল্পের প্রসার হতে থাকে। এখন থেকে ২৫ বছর আগে এ অঞ্চলে ৬-৭ হাজার তাঁতি তাদের জাত পেশা হস্তচালিত তাঁতশিল্পে নিয়োজিত ছিল। তারা তাদের হস্তচালিত তাঁতশিল্পের মাধ্যমে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ও বিছানার চাদর তৈরি করে স্থানীয় বাজার ও বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবিকা নির্বাহ করত। ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত বিন্নকুড়ী এবং রানীরবন্দর কৃষি ব্যাংক শাখা থেকে গৃহীত ঋণের টাকাও পরিশোধ হচ্ছিল নিয়মিত। এ অবস্থায় তাদের উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বাদ সাধলো ১৯৮৭ ও ’৮৮ সালের পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগে। ওই দুই বছর সর্বনাশী বন্যার পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়ের ফলে শতাধিক তাঁত ফ্যাক্টরিসহ হাজার হাজার তাঁতির তাঁতের সুতা-কাপড়ও বিধ্বস্ত হয়। ফলে তাঁতিদের ভাগ্যে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। এ অবস্থাতেও তাঁতিরা তাদের জায়গাজমি বিক্রি করে পুনরায় নব উদ্যোগে শুরু করে তাঁতের তৈরি কাপড়ের ব্যবসা।  

পর্যায়ক্রমে তাঁতশিল্প ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়। ওই অবস্থায় তাঁতিরা তাদের জাত পেশা ছেড়ে কেউ রিকশাচালক, কেউবা মোটর শ্রমিক, আবার কেউবা দিনমজুরের কাজ করে কোনো রকমে কায়ক্লেশে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। বর্তমানে ঋণগ্রস্ত তাঁতি ও তাঁত শ্রমিক পরিবারগুলো জীবন রক্ষার্থে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করে পুরনো প্লাস্টিক সংগ্রহের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে অতিকষ্টে দিন অতিবাহিত করছে।  

বর্তমানে রানীরবন্দর এলাকায় সচ্ছল কিছু তাঁতি পরিবার তাদের এই ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অপরদিকে হাজার হাজার তাঁতি তাদের শেষ সম্বল তাঁতগুলোও বিক্রি করে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এর ওপর আবার ব্যাংকের দেনা পরিশোধ করতে না পারায় ঋণখেলাপির দায়ে সার্টিফিকেট মামলার সম্মুখীন হয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।  

এ ব্যাপারে এই ব্যবসার সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে জড়িত রানীরবন্দরের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী সেকেন্দার আলী জানান, এ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার যদি উদ্যোগ নিয়ে তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িতদের পুনরায় সুদমুক্ত বা স্বল্প সুদে ব্যাংক থেকে ঋণ প্রদান করে, তাহলে এ অঞ্চলের তাঁতশিল্পের সুদিন আসবে। উল্লেখ্য, রানীরবন্দরের তাঁতশিল্পকে কেন্দ্র করে ওই স্থানে গঠিত হয়েছিল তাঁতি সমবায় সমিতি লিমিটেড। সমিতির অফিস ঘরের অবকাঠামোটি এখনো বিদ্যমান। দিনাজপুর জেলা সমবায় দফতরের তাঁত পরিদর্শকের একটি পদও আছে। শুধু তা-ই নয়, তাঁত তত্ত্বাবধায়কের একটি পদও সমবায় দফতরে বিদ্যমান। কিন্তু ভুক্তভোগী এবং এলাকাবাসীর প্রশ্ন, সমবায় দফতরের তাঁত-সংশ্লিষ্ট দুটি পদ থাকার পরেও এই ঐতিহ্যবাহী সমবায় সমিতিটি কেন বিলুপ্ত হলো এটাই অবাক হওয়ার বিষয়। এ ব্যাপারে এলাকাবাসী তথা তাঁতিদের দাবি- তাঁতশিল্পকে আবার ফিরিয়ে আনতে নতুনভাবে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করুক। সেই সঙ্গে জেলা সমবায় দফতর সমবায় আইন অনুযায়ী পুনরায় সমিতিটি চালু করুক। দিনাজপুর জেলার ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পটি আবার প্রাণ ফিরে পেলে বস্ত্রশিল্পে বিপ্লব ঘটবে দিনাজপুরে। পাশাপাশি দিনাজপুর জেলার ব্র্যান্ডিংয়ে যোগ হবে রানীরবন্দরের তাঁতশিল্প।  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads