প্রধান প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বিশ্বের দৃষ্টিতে এখন বাংলাদেশ। দেশে জমির পরিমাণ বাড়ছে না, বরং কমছে। তারপরও বীজ ও চাষে নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং তার প্রয়োগে খাদ্যশস্যের উৎপাদন অনেক বেড়েছে। শুধু উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ফলনের দিক দিয়েও বাংলাদেশ অধিকাংশ দেশ থেকে অনেক এগিয়ে। অথচ শুধু বিপণন দুর্বলতার কারণে এর সঠিক সুফল পাচ্ছেন না কৃষকসহ ভোক্তারা। চলতি বছর দেখা গেছে দুই টাকা কেজিতেও টমেটো বিক্রি করতে পারছেন না কৃষক। ফলে অনেক স্থানেই ফসল ক্ষেতেই ফেলে রাখতে দেখা গেছে। অথচ রাজধানীতে সেই টমেটো ১৫ থেকে ২০ টাকায় কিনতে হয়েছে ক্রেতাদের। আবার বাম্পার আলু ফলিয়ে কৃষক বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাব এবং সরবরাহ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে এ পরিস্থিতি।
কৃষিসংশ্লিষ্ট ও বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে পণ্য বিপণনে নিয়োজিত কোনো সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঠিক তদারকি নেই। ফলে সিন্ডিকেট করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। বিপণন দুর্বলতার কারণে ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। সরকারও আছে হাত গুটিয়ে।
তথ্য বলছে, দেশে ধান, গম, ভুট্টা, শাকসবজিসহ ফলমূলের উৎপাদন স্বাধীনতার পর অনেক গুণ বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রধান খাদ্যের (ধান, গম, আলু) চাষ ও উৎপাদনের ৪৫ বছরের (১৯৭০-৭১ থেকে ২০১৪-১৫ পর্যন্ত) পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। সেখানেও দেখা যায়, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রধান খাদ্যের উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ টন, যা স্বাধীনতার পরের বছর ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ টন। এ ছাড়া সবজি, ফলসহ অন্যান্য ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) তথ্য বলছে, সম্প্রতি বছরগুলোয় বেশ দ্রুত বেড়েছে উৎপাদন। প্রতি পাঁচ বছরে দেশে ডাল উৎপাদন ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২.৩ শতাংশ, তৈলবীজ ২.৩ থেকে বেড়ে ৩.৯, আলু ১.৭ থেকে বেড়ে ১.৮, শাকসবজি ৩.৮ থেকে বেড়ে ৩.৯ শতাংশ হয়েছে।
তবে ভোক্তা হিসেবে সাধারণ মানুষ এর সুফল পাচ্ছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ খানার আয় ও ব্যয় নির্ধারণ জরিপ-২০১৬-তে দেখা যাচ্ছে একটি পরিবারের মোট খরচের ৪৭ শতাংশই চলে যাচ্ছে খাবারের পেছনে। একটি পরিবারের মাসিক আয় গড়ে ১৫ হাজার ৮৯৩ টাকা। যার মধ্যে ৭ হাজার ৩৫৪ টাকা ব্যয় হয় খাবার কিনতে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্মানিত ফেলো এম আসাদুজ্জামান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা দেখেছি চালের উৎপাদন এত বাড়ার পরও কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে দেশের মানুষ। যার বড় কারণ বিপণন দুর্বলতা। পণ্য শুধু উৎপাদন করলেই চলবে না, এর সঠিক বিক্রয় ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারের কোনো সংস্থাই এ কাজটি করে না। শুধু একে-অন্যের ওপরে দোষ চাপাতেই তারা ব্যস্ত।
তিনি বলেন, উন্নত দেশে ‘অ্যাগ্রিকালচার মার্কেটিং কমিশন’ আছে। যারা পণ্যের উৎপাদন থেকে ভোক্তা পর্যন্ত দাম নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। পণ্য বিপণনের বিকল্পব্যবস্থা করে। আমাদের দেশেও এ ধরনের শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা প্রয়োজন। নতুবা কৃষক যেমন ফসলের ন্যায্য দাম পাবেন না, তেমনি ভোক্তাকেও তা অস্বাভাবিক মূল্যে পণ্য কিনতে হবে। বিপণন দুর্বলতা কাটানো এবং এ খাতে অর্থায়নের প্রয়োজন এমন সুপারিশ এসেছে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত বিষয়ে দ্বিতীয় কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যানেও (সিআইপি)। তাতে বলা হয়েছে, পাঁচ বছর (২০১৬-২০২১) মেয়াদি ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দরকার ২৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। যেখানে অধিকাংশ ব্যয় হবে পণ্য বিপণনে।
সিআইপি প্রতিবেদনে বিনিয়োগের জন্য ১৩টি খাত শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে পণ্য উৎপাদনে বিকেন্দ্রীকরণ পদ্ধতি উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। চার হাজার কোটি টাকা লাগবে কৃষি পণ্য সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থাপনার জন্য। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে উৎপাদিত পণ্য রক্ষার জন্য বিনিয়োগ করতে হবে ৩ হাজার ৪০ কোটি টাকা এবং উন্নত পণ্য সংরক্ষণ ব্যবস্থায় দরকার হবে ৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।
দেশে পণ্য বিপণন তদারকির জন্য যে কোনো সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা নেই, তা কিন্তু নয়। তবে বাজারে তাদের কোনো ভূমিকাই নেই। ১৯৭২ সালে মুক্তবাজার অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সরকারের বিপণন সংস্থা হিসেবে পরিচিত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। বাজার স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আপদকালীন মজুত গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব। তবে শুধু রমজানে চার-পাঁচটি পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করেই দায় সারছে টিসিবি। বাজারমূল্য স্থিতিশীল রাখতে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা শুধু রাজধানীর কয়েকটি বাজারে পণ্যের দর ওয়েবসাইটে প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
আর দেশের কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করতে ‘কৃষি বিপণন বিভাগ’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্বাধীনতার আগেই, যা পরে কৃষি বিপণন অধিদফতরে রূপান্তরিত হয়। বিপণন অধিদফতরে মূল কাজ কৃষিব্যবসা ও কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে রফতানি বৃদ্ধিতে সহায়তা, উৎপাদক ও বিক্রেতার সঙ্গে ভোক্তার সংযোগ স্থাপন ও কৃষিপণ্যের বাজারদর মনিটরিং করা। তবে তা শুধু আইনেই রয়ে গেছে। বাজারে পণ্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারীদের নির্মূল ও সুস্থ প্রতিযোগীকে উৎসাহিত করার জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করা হয়েছিল ছয় বছর আগে। তবে তা এখনো অকার্যকর।