বিশেষ প্রতিনিধি:
আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৫ বছরে বেসরকারি খাতে প্রায় ১০০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের লাইসেন্স দিয়েছে। তবে কোন দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংক্রান্ত বিশেষ আইনে কেন্দ্রগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়। যদিও ২০১০ সাল থেকে অনুমোদন দেওয়া ছোট-বড় এসব কেন্দ্রের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বরং উল্টো দায়মুক্তি আইন পাস করে বিচারের পথ রুদ্ধ করেছে সরকার, যে আইন এখন বহাল রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিডিবির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানের হাত দিয়ে বিগত সরকারের আমলে অধিকাংশ প্রকল্প নির্মাণ হয়েছে। ফলে এ দীর্ঘ সময়ে তার তত্ত্বাবধায়নে বিদ্যুৎ বিভাগে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এছাড়া বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক সচিব আবুল কালাম আজাদ ও আহমদ কায়কাউসও বড় বড় অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এই দুজনই পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব পদে দায়িত্ব পালন করেন। এমনকি কী আবুল কালাম আজাদ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামালপুর-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হন।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ছোট ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু এবং সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর এক ভাতিজা মিলে অন্তত ৪টি কোম্পানির মাধ্যমে ৫ বছরে বাগিয়ে নিয়েছেন ৮ হাজার কোটি টাকার কাজ। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর সব খাতে ব্যাপক ওলটপালট হলেও বিদ্যুৎ সেক্টর থেকে এই ভূত এখনো দূর হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ খাতে মোট ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৮৩০ কোটি ডলার। বর্তমান বিনিময় হার বিবেচনায় (১ ডলার সমান ১১৮ টাকা) বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। একই সময় শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামেই লুটপাট হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন না করে শুধু সক্ষমতা দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ এই টাকা নিয়ে গেছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো। এসব কেন্দ্রের বেশির ভাগের মালিক আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা তাদের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, বিগত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আইপিপি, রেন্টাল, ক্রসবর্ডার বা ইন্ডিয়া থেকে আমদানিসহ বিদ্যুৎ ক্রয় খাতে প্রায় ৮৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জই দেয়া হয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। আমদানি করা এ বিদ্যুৎ প্রকল্প ব্যায়ে বড় ধরনের লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই ব্যয় প্রক্রিয়ার সাথে বিউবোর সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমানসহ তার অত্যন্ত বিশ^স্ত (হিসাব, অর্থ ও নিরীক্ষা নিয়ন্ত্রক) কর্মকর্তা নাছরুল হক, অর্থ পরিদপ্তরের পরিচালক হাবীব উল্লাহ, অতিরিক্ত পরিচালক (বহিঃঅর্থ) রুহুল কবির, উপ-সচিব আব্দুল হালিম, উপ-পরিচালক (ফান্ড) নুরুস ছাফা ও মেহবুব মোর্শেদ প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। এরা দীর্ঘদিন যাবৎ একই দপ্তরে কর্মরত থাকায় সিন্ডিকেট অনেক শক্তিশালী হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো একাধিকবার সরকারের কাছে বিক্রি করেছে মালিকরা। সেই সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে গুটিকয়েক কোম্পানি।
এছাড়া বিগত ১৫ বছরে কোনো দরপত্র ছাড়াই বেসরকারি খাতে শতাধিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এর বেশির ভাগই কোনো কাজে আসেনি। সরকারি হিসাবে উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট বলা হলেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি মেলেনি। এমনকি দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত চাহিদা কত, তারও সঠিক কোনো হিসাব নেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে। সবার জন্য সরবরাহ নিশ্চিত না করে শুধু সংযোগ দিয়েই শতভাগ বিদ্যুতায়নের কৃতিত্ব জাহির করা হয়েছে।
অন্যদিকে গত জুলাইয়ে পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকার ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। তবে পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব যোগ করলে তা ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ওই সময়ে সরকার-ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সামিটকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে দেওয়া হয়েছে প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল। কোম্পানিটিকে দেওয়া হয়েছে ৭ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। ৭ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে আছে চীনা কোম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস।
চতুর্থ স্থানে দেশি কোম্পানি ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া হয়েছে ৬ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। পঞ্চম স্থানে থাকা রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডকে (আরপিসিএল) দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বাংলা ক্যাট গ্রুপ নিয়েছে ৫ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। মাত্র তিন বছর আগে উৎপাদন শুরু হওয়া বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পেয়েছে ৪ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।
এছাড়া ওরিয়ন গ্রুপকে ৪ হাজার ৮৬২ কোটি এবং খুলনা পাওয়ার কোম্পানিকে (কেপিসিএল) ৪ হাজার ৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সামিট গ্রুপের কাছে ও ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে। ফলে খুলনা পাওয়ারের ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের কাছে।
দেশীয় কোম্পানি হোসাফ গ্রুপ ২ হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা, মোহাম্মদী গ্রুপ ২ হাজার ৫৪৪ কোটি, ডরিন গ্রুপ ২ হাজার ১৮৩ কোটি ও ম্যাক্স গ্রুপকে ২ হাজার ১৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জিকে ২ হাজার ৮৭ কোটি এবং সিঙ্গাপুরের সেম্বকর্পকে ২ হাজার ৫৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
শাহজিবাজার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপ ১ হাজার ৮৪২ কোটি ও কনফিডেন্স গ্রুপকে ১ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউ ইংল্যান্ড পাওয়ার কোম্পানির এনইপিসি কনসোর্টিয়ামের হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে ১ হাজার ৫২৮ কোটি টাকা পেয়েছে।
শ্রীলংকান কোম্পানি লক্ষধনভি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসকে ১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা, সিনহা গ্রুপকে ১ হাজার ৩৯১ কোটি, আনলিমা গ্রুপকে ১ হাজার ২৭৪ কোটি, বারাকা গ্রুপকে ১ হাজার ২৪৭ কোটি, রিজেন্ট গ্রুপকে ১ হাজার ৩৭ কোটি এবং এনার্জিপ্যাককে ১ হাজার ২৭ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এই তালিকায় আরও কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, যাদের ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের পরিমাণ ১ হাজার কোটি টাকার কম। এ ছাড়া ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে গিয়ে গত ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা।
দেশটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছর। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল প্রায় ৫০১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর আমদানি বাড়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে দাঁড়ায় ৯২২ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮৪০ কোটি টাকা। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি কিছুটা বাড়ায় বেড়েছে ক্যাপাসিটি চার্জও। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় ১ হাজার ৭৮ কোটি টাকা।
অন্যদিকে শুরুতে তিন বছর মেয়াদে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। আবার একই কেন্দ্র সরকারের কাছে একাধিকবার বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলেন, এসব কেন্দ্রের মোট বিনিয়োগের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ বিনিয়োগকারী দেয়, বাকিটা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে মেটানো হয়। পিডিবি তথা সরকার সুদসহ সেই ঋণ (চুক্তি অনুযায়ী) ৩ বছরে শোধ করে দেয়।
পাশাপাশি ইক্যুইটি ইনভেস্টমেন্টের ওপর দেওয়া হয় মুনাফা (রিটার্ন অব ইকুইটি)। সরকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় শোধ করে দিলেও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটা ওই কোম্পানিরই রয়ে যায়। পরে মেয়াদ বাড়ানো হলেও একই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে ফের নির্মাণ ব্যয় পরিশোধ করা হয়। তা আগের চেয়ে কিছুটা কম হয়। এভাবে রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে লুটপাট করা হয়েছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ আইনের কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হয়নি। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার হতে হবে। নতুন সরকার এসেছে। আমরা নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি। ফলে এ খাতে নীতি ও কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে। আর না হলে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব না।





