মুক্তমত

বাসযোগ্য বাংলাদেশ গড়ে তুলি

  • প্রকাশিত ৩১ অগাস্ট, ২০২১

আ.ব. ম রবিউল ইসলাম

 

বিভিন্ন কারণে প্রকৃতি বিমুখ হচ্ছে, ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ব্রজপাত, ভূমিকম্পে মানুষ মারা যাচ্ছে। পাহাড় ধস, খড়া, বন্যা ইত্যাদি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব দুর্যোগে সাধারণ মানুষের এখন টিকে থাকার লড়াই চলছে প্রতিনিয়ত। অতীতেও এসব বিপর্যয় ছিল, কিন্তু এতটা প্রকোপ ছিল না। একটু স্থির হয়ে ভাবুন তো, কেন এসব হচ্ছে? কে বা কারা দায়ী এসবের পেছনে? ইচ্ছেমতো  আমরা বনের গাছ চুরি করছি, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে গাছ কাটছি। বন না থাকায় আমদের পশুপাখিও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা ইচ্ছেমতো পাহাড় কাটছি, নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছি। মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে আমরা জমির উর্বরতা নষ্ট করে চলেছি। মাটির বিষ পানিতে মিশে আমাদের মাছের প্রজাতিকে বিলুপ্ত করছে। কলকারখানা, যানবাহন, ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়া, শব্দদূষণ, ট্যানারির বর্জ্য, নগরীর সাধারণ ও শিল্পবর্জ্যের অব্যবস্থাপনা—সব মিলিয়ে বিষিয়ে তোলা হচ্ছে পরিবেশ। এত প্রতিকূলতা, এত অব্যবস্থাপনা—সেই প্রতিকূল পরিবেশে জীবন ও জনপদ কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে?

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগের সর্বোচ্চ ঝুঁকির সূচকে বাংলাদেশ ছয় নম্বরে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে প্রতি সাত জনের একজন স্থানচ্যুত হবে। জেনেভাভিত্তিক ‘দ্য ইন্টরন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার’ (আইডিএমএস)-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, দুর্যোগের কারণে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের প্রায় চার দশমিক সাত মিলিয়নেরও বেশি লোক স্থানচ্যুত হয়েছে। অ্যাসেসমেন্ট অব সি লেভেল রাইজ অন বাংলাদেশ কোস্ট থ্রু ট্রেন্ড অ্যানালাইসিস অনুযায়ী বাংলাদেশের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর ২১ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠে উচ্চতা আর এক মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ উপকূল এবং নিম্নাঞ্চলসহ প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এলাকা তলিয়ে যেতে পারে। এতে উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯ জেলার ৭০ উপজেলার প্রায় চার কোটি লোক প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে এই জনগোষ্ঠির বড় একটি অংশ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিবেশ দূষণের হাত থেকে বিশ্বকে বাঁচানোর অঙ্গীকার নিয়ে প্রতি বছর ৫ জুন জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) উদ্যোগে ১০০টিরও বেশি দেশে পরিবেশ দিবস পালন করা হয়।

ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে প্রকাশিত ‘এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মানবজীবনের জলবায়ুর প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রায় ১৩ শতাংশ ভূখণ্ড সমুদ্রে বিলীন হয়ে যেতে পারে। আগামীতে বাংলাদেশেরে বন্যার প্রভাব ২০ শতাংশ বাড়তে পারে। গড় তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি পযর্ন্ত বাড়লে ২০৮০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে ৬২ সেন্টিমিটার। ফলে সমুদ্র উপকূলে থাকা প্রায় ১৩ শতাংশ ভূখণ্ড বিলীন হয়ে যেতে পারে। বন্যার শিকার হতে পারে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ ভূমি। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ শতাংশ ভূমি সমুদ্রে বিলীন হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। এক ভয়ানক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা।

পরিবেশের চরম ক্ষতিকারক আরেক বস্তুর নাম প্লাষ্টিক ও পলিথিন। সমুদ্র দূষণের ভয়াবহতা দিন দিন এমন পর্যায়ে পৌছাচ্ছে যে, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে মাছের চেয়ে বেশি থাকবে প্লাস্টিক। এই তথ্যটি জানাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম জার্নাল। সংস্থাটি বলছে, গত ৫০ বছরে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বেড়েছে, যা আগামী ২০ বছরে এই পরিমাণ দ্বিগুণ হতে পারে। জানা গেছে, বর্তমানে মাছ ও প্লাস্টিকের অনুপাত ১ : ৫। ২০৩০ সালে এই অনুপাত হবে ১ : ৩। ভয়ানক খবরটি জনাচ্ছে বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। তারা বলছে, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির ব্যবহার ৮০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইকোব্রিকস নামে পরিবেশ সচেতনতাবাদী একটি সংগঠন মানুষকে প্লাস্টিক বোতলের মধ্যে নরম প্লাস্টিকবর্জ্য ভরে ব্লক তৈরির জন্য উৎসাহিত করছে। আমরা জানি, পরিবেশদূষণের উপাদানগুলোর মধ্যে পলিথিন ও প্লাস্টিক অন্যতম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের কণাগুলো এতোই ক্ষুদ্র যে, মাছ খাদ্য হিসাবে সেগুলো খেয়ে বড় হচ্ছে আর আমরা ওই মাছগুলো খাচ্ছি, যা কি না ক্যানসারের অন্যতম কারণ। অপরদিকে পলিথিন এমন একটি উপাদানে তৈরি, যা থেকে বিষ নির্গত হয় এবং খাদ্যদ্রব্যের সাথে মিশে যায়। পলিথিন কখনো মাটির সাথে মেশে না, বরং ভূমির উর্বরতা নষ্ট করে। তাই আমাদের পলিথিন বর্জন এখন সময়ের দাবি। আর এটা আজ থেকেই শুরু করতে হবে যা আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় জরুরি হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি পাটের পণ্য ব্যবহারের আবশ্যিকতা দেখা দিয়েছে। বর্তমানে পাটের ব্যাগ উৎপাদনে সরকার গুরুত্ব দেওয়ায় ইতোমধ্যে জনগণের মাঝেও এ বিষয়ে সচেতনতা লক্ষ করা গেছে। এই ইতিবাচকতাকে আমাদের ধরে রাখতে হবে এবং এ বিষয়ে ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক। এক্ষেত্রে গণমাধ্যমকেও এগিয়ে আসতে হবে।

আর এভাবেই আমার আমাদের বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করতে পারি। এক্ষেত্রে আমাদের দ্রুত কিছু পরিকল্পনা গ্রহণও জরুরি হয়ে পড়েছে। যেমন—যে পরিমাণ গাছ আমরা  অপ্রয়োজনে কেটেছি বা কাটছি তার বিপরীতে দ্বিগুন গাছ লাগাতে হবে। একটি দেশের জন্য যে পরিমাণ বন থাকার কথা আমাদের তা নেই। ২৫% বনায়নের বিপরীতে আমাদের রয়েছে ১৭% বন। সুতরাং বনায়ন সৃষ্টিতে কাজ করতে হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি অফিস, খাসজমি, রাস্তার দুই ধারে, রেল সড়কের দুপাশে এবং উপকূলীয় এলাকায় প্রচুর গাছ লাগাতে হবে। এমনকি ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষায় বেশি করে বজ্ররোধক তাল গাছ লাগাতে হবে। একুশ শতকের জন্য নির্মল বাতাসের উপযোগি শহর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে আমাদের এই সবুজ শ্যামল খ্যাত জন্মভূমি বাংলাদেশকে। আর তার জন্য যা যা করণীয় তা আমাদের সম্মিলিতভাবে শুরু করতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। সকলকে সেদিকেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করছি।

 

লেখক : শিক্ষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads