পণ্যবাজার

বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ঘুমে

  • প্রকাশিত ২২ মার্চ, ২০২৪

রহমত আলী খন্দকার:

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। রমজান শুরুর আগে থেকেই জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির উৎসবে মেতে ওঠে অসাধু ব্যবসায়ীরা। ফলে প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে দ্রব্যমূল্যের দাম। এ অবস্থায় নিজেদের দায়মুক্ত রাখতে লোক দেখানো কর্মসূচি নিয়েছে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে থাকা সরকার সংস্থাগুলো।

পণ্যের বাজার মনিটরিং করতে সরকারের তিনটি মন্ত্রণালয় ও ১১টি সংস্থা আছে। সেগুলো হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, টিসিবি, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, ট্যারিফ কমিশন, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন। নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ অভিযান বলতে গেলে ব্যর্থ হয়েছে। সংস্থা গুলোর কিছু কার্যক্রম চালালেও তা বাজার নিয়ন্ত্রণ করার জন্য পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান থাকলেও তাদের মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের অভাবে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ভোক্তাদের দুর্ভোগও কাটছে না।

গত শুক্রবার ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েই সকল দায় শেষ করেছে অধিদপ্তর। রাজধানীর অন্তত ছয়টি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই অধিদপ্তরের দাম মানছেন না। ২৯ পণ্যের মধ্যে একটিও নির্ধারিত দামে বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

২০১৮ সালের এ আইনে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কার্যাবলিতে বলা হয়েছে, কৃষিপণ্যের মূল্য প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন এ সংস্থার অন্যতম প্রধান কাজ। বাজার নিয়ন্ত্রণে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে। গুদাম বা হিমাগারে খাদ্য মজুতের হিসাব তলব, কৃষিপণ্যের মূল্য বেঁধে দেওয়া, সিন্ডিকেটকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সংস্থাটির কাজ। এমনকি মার্কেট চার্জ বা ভাড়া নির্ধারণও করে দিতে পারে সংস্থাটি। আইনে যথেষ্ট ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বাজারে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না সংস্থাটি। কৃষিপণ্যের বাজার তদারকির দায়িত্বে থাকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে বাজারে খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে দাম নির্ধারণ করেই দায় শেষ করছে সংস্থাটি। অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত থাকা কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের কেউ-ই যান না বাজারে। যদিও এর জন্য সংস্থার কর্মকর্তারা দায় চাপচ্ছে অন্যের ওপর। নিজস্ব লোকবল কম থাকা এবং চাহিদা মতো ম্যাজিস্ট্রেট না পাওয়াকে দায়ি করছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা দাম বেঁধে দিইনি, যৌক্তিক দাম কত হওয়া উচিত, তা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সে অনুযায়ী সংস্থাগুলো অভিযান চালাবে, ব্যবস্থা নেবে। আমাদের জনবল সংকট আছে। তিনি বলেন, মাঠ থেকে আসা তথ্য বিশ্লেষণ করেই দাম নির্ধারণ করেছি। এই ২৯ পণ্যের দর সব অংশীজনের সঙ্গে আলাপ করে নির্ধারণ করা হয়েছে, ফলে বাস্তবায়ন সম্ভব।

প্রতিযোগিতা কমিশন : প্রতিযোগিতা কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, একটি আধুনিক ও কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হলো ব্যবসা ও বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি স্বাভাবিক রেখে মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ করা এবং বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা। বাজারে ন্যায্য প্রতিযোগিতা বজায় থাকলে তা পণ্যের দাম কমাতে সাহায্য করে। বাজারে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ও ন্যায্য প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন দেশে প্রতিযোগিতা আইন করা হয়। বাংলাদেশ ২০১২ সালে প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়ন করে। এই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার পণ্য ও পরিষেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, সঞ্চয় বা অধিগ্রহণ নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। প্রতিযোগিতা কমিশন আইনকে অনেক শক্তিশালী করা হয়েছে, ‘বাজারে যেকোনো জায়গায় হস্তক্ষেপ করতে পারে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। যারা দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসা করতে চায় তারা জনগণের কল্যাণে করে। আর যারা স্বল্প মেয়াদে জনগণের পকেট কেটে ধনী হতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতেই প্রতিযোগিতা কমিশন। দুর্বল ভোক্তা ও আপামর জনসাধারণকে রক্ষা করতেই সরকারের এই পদক্ষেপ।’ ২০১৬ সালের এপ্রিল থেকে কাজ করছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। তবে বিগত ৮ বছরে উৎপাদন বা ভোক্তা পর্যায়ে নিজেদের কতোটাই বা চেনাতে পেরেছে বিচারিক ক্ষমতাসম্পন্ন এই সংস্থাটি তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

অধ্যাপক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, দ্রব্যমূল্য ও বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা আইন ও প্রতিযোগিতা কমিশনের কাজের পরিধি বাড়াতে হবে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ, বাজার ব্যবস্থাপনা, বাজার নিয়ন্ত্রণ ও ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় প্রতিযোগিতা আইনের ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে গণসচেতনতা তৈরির মাধ্যমে প্রতিযোগিতা কমিশন ও সংশ্লিষ্ট বাজার নিয়ন্ত্রক বা রেগুলেটরি সংস্থাগুলোগুলোকে অধিকতর শক্তিশালী ও ক্ষমতায়ন করার মাধ্যমে সামগ্রিকভাবে বাজার সুরক্ষা, ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা, বিনোয়োগবান্ধব পরিবেশ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, ‘আমাদের একেক সংস্থার একেক ধরনের ম্যান্ডেট। আমরা বাজারে যারা পণ্যের প্রতিযোগিতা বাধাগ্রস্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেই। এটা একটা কোয়াসি বিচারিক প্রতিষ্ঠান। আমরা অভিযোগ পেলে মামলা করি। আবার সরাসরি নিজেরাও মামলা করি। গত বছর ডিম, ব্রয়লার মুরগি নিয়ে আমরা নিজেরাই মামলা করে ব্যবস্থা নিয়েছি।

ক্যাবের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সরকার ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থা যত হাকডাকই দিক না কেন তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। বাজারের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে। তারা যেভাবে চায় সেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।’ এবার রোজার আগে চার ধরনের পণ্যের শুল্ক কমালেও একমাত্র ভোজ্য তেল ছাড়া আর কোনোটির দাম কমেনি। সয়াবিন তেল লিটারে ১০ টাকা কমানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম অর্ধেকে নেমে এসেছে। চাল, ভোজ্য তেল, চিনি ও খেজুর এই চারটি পণ্যের শুল্ক কমানো হয়েছে। এরমধ্যে চাল আমদানি হয় না। ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘তেলের দাম কমেছে। চিনির শুল্ক সামান্যই কমানো হয়েছে। তার প্রভাব বাজারে পড়ার কথা নয়। সাধারণ মানের খেজুরের দাম বেঁধে দিয়েছি। আর যে খেজুর এখন বাজারে আছে তা আগে আমদানি করা। সবজি ও কাঁচাবাজার এবং ফলের বাজার ঠিক রাখতে আমরা অভিযান চালাচ্ছি।’

টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিছুটা সাশ্রয়ী মূল্যে সাধারণ মানুষের কাছে তেল, চিনি, ডালসহ কয়েকটি পণ্য বিক্রি করছে সরকারি বিপণন সংস্থাটি। তবে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছে না তারা। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হয় অনেকের। এ অবস্থায় বাজার বিশ্লেষকরা টিসিবির প্রয়োজনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গেই দেখছেন। তাদের মতে টিসিবি বিদ্যমান কার্যক্রম যথেষ্ট নয়। তবে এই বিরাট জনগোষ্ঠীর বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে টিসিবির যে সামর্থ্য থাকা প্রয়োজন, সেটি তাদের নেই। সংস্থাটির পণ্য বিক্রি কার্যক্রম চলে শুধু স্বল্প আয়ের মুষ্টিমেয় লোকের জন্য। সেটিও বছরব্যাপী নয়। বিক্রীত পণ্যের সংখ্যাও কম। এ অবস্থায় সংস্থাটির সক্ষমতা আরো বাড়াতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লষকরা।

সচেতনতা তৈরি, বাজারে প্রতারণা বন্ধ করা, পণ্যের মান ঠিক রাখাসহ নানা কাজ করা লাগে। এর মধ্যেও আমরা বাজার তদারকি করছি। আমাদের জনবল কম। রাত-দিন কাজ করছি। তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের অনেক জনবল, অনেক ক্ষমতা তারা চাইলে বাজার তদারকিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, শনিবার সারাদেশে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ৫৫টি অভিযান চালিয়ে ১৪১ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ৭ লাখ ৫২ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে যথেষ্ট আইন ও প্রতিষ্ঠান আছে এবং এটি ইতিবাচক দিক বলে মন্তব্য করে তিনি তিনটি দিকের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো প্রথমত, এসব প্রতিষ্ঠানের জনবলের সক্ষমতা বৃদ্ধি, তাদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে শক্তিশালী করা। দ্বিতীয়ত, এসব প্রতিষ্ঠানকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে তা প্রয়োগ করা অর্থাৎ কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার না করা। তৃতীয়ত, অধিকারের বিষয়ে ভোক্তাদের নিজেদেরই সচেতন হওয়া।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads