সম্পাদকীয়

বাঘ সংরক্ষণের প্রশংসনীয় উদ্যোগ

  • অনলাইন ডেস্ক
  • প্রকাশিত ৩০ অগাস্ট, ২০২১

আলম শাইন

 

বিশ্বঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে চলতি বছর শুরু হয়েছে বাঘ শুমারি। তবে এবারের শুমারিতে বরাবরের মতো বিদেশি কোনো বিশেষজ্ঞ থাকছে না। সংশ্লিষ্টরা এবারের শুমারি শুরুর ছয় মাসের মধ্যেই ফল পাওয়ার আশা করছেন। এর আগে ২০১৮ সালের সর্বশেষ শুমারিতে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১১৪টি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, খুলনা বিভাগীয় বন বিভাগ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। তবে বিদেশি বিশেষজ্ঞ না থাকলেও এবার ভালো ফল পাওয়ার আশা রয়েছে। এর আগে বাঘের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণী সংরক্ষণের আঞ্চলিক সহযোগিতার জোরদারকরণ প্রকল্প নেওয়া হয়। এ প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাতিসহ সব প্রাণীর অবলুপ্তির অংশ হিসেবে সুন্দরবনের বাঘ শুমারি শুরু হয়। এছাড়া ক্যামেরায় ছবি তোলার মাধ্যমে ২০১৩ সাল ও ২০১৮ সালে বাঘ শুমারি হয়। ৮৯টি ইনফ্লারেড নামক ক্যামেরার মাধ্যমে বাঘ শুমারি হয়। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮২ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৫৩। ১৯৮৫ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা ৪৫০। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র বিশেষজ্ঞদের মতে, ১৯৯৪ সালের বাঘের সংখ্যা ৩৬৯টি। ২০০৪ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ও বন বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ৪৪০। ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা ১০৬টি, সর্বশেষ ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪টি।

সুন্দরবন বিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০০১-২০২১ সাল পর্যন্ত সিডর, বার্ধক্যজনিত, গণপিটুনি ও শিকারিদের হাতে সুন্দরবনের পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে ৩০টি বাঘ মারা পড়ে। ওয়ার্ল্ড লাইফ ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান রনথম্বোর ফাউন্ডেশন ও ওয়ার্ল্ড নেচার ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা হার অব্যাহত থাকলে ২০৭০ সাল নাগাদ এখানে বাঘের সংখ্যা নির্ণয় ৯৬ শতাংশ কমে যাবে। প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১২ জুন ঢাকার শ্যামলী থেকে উদ্ধার হওয়া তিনটি বাঘের শাবক ডুলাহাজারার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে ছেড়ে দেওয়া হয়।

সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘ এ পর্যন্ত যত মানুষকে আক্রমণ বা হত্যা করেছে তাদের বেশিরভাগই বাওয়ালি, মৌয়াল, জেলেসহ বিভিন্ন ধরনের শিকারি কিংবা চোরাকারবারি। খুব কমই আক্রান্ত হয়েছেন পর্যটক। কারণ পর্যটকদের প্রতি আগে থেকেই সতর্কতার নোটিশ দেওয়া থাকে কর্তৃপক্ষের।

অপরদিকে পেশাজীবী কিংবা চোরাকারবারিদের চলাফেরায় থাকে বেপরোয়া গতি, ফলে যে কোনো মুহূর্তে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মুখোমুখি হতে হয় ওদের। যে মানুষটি একবার রয়েল বেঙ্গলের মুখোমুখি হয়েছেন সে মানুষ বেঁচে ফিরে এসেছেন খুব কমই। এলেও মৃতপ্রায় হয়ে ফিরে এসেছেন কিংবা বিকৃত চেহারা নিয়ে ফিরেছেন।

এক সমীক্ষায় জানা যায়, স্বভাবে সুন্দরবনের বাঘ শুধু হিংস্রই নয়; উগ্র হিংস্র। ওদের এ হিংস্রতাই শাপেবর হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্যটা আজ অব্দি টিকে রয়েছে শুধু রয়েল বেঙ্গলের হিংস্রতার কারণে। তাই সাধুবাদ জানাতে হয় এ অতন্দ্রপ্রহরীকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হচ্ছে, যে অতন্দ্রপ্রহরী নিজ দায়িত্বে সুন্দরবন রক্ষা করছে সে প্রাণীটি নিজেকে এবং তার শাবককে রক্ষা করতে পারছে না চোরাকারবারিদের কবল থেকে। চোরাকারবারিরা বিভিন্ন কৌশলে পরাস্ত করে প্রাণ কেড়ে নিয়ে ওদের চামড়া ছিলে হাড়গোড় সংগ্রহ করে পাচারের উদ্দেশ্যে লোকালয়ে নিয়ে আসে। অতঃপর রাজধানী হয়ে চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া ও মঙ্গোলিয়ার বিভিন্ন ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে চলে যায়। লোভের বশবর্তী হয়ে চোরাকারবারিরা বাঘের পেছনে লেগেই থাকে। লগ্নিও করে প্রচুর অর্থকড়ি।

এমন ঘটনা বার বার সুন্দরবন অঞ্চলে ঘটেছে, যার প্রমাণও রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি এমন ঘটনা ঘটিয়েছে চোরাকারবারিরা। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলায় র্যাব-৮ এর সদস্যরা চোরকারবারিদের ধরতে সক্ষমও হয়েছেন। সেই সঙ্গে উদ্ধার করেছেন ৯ ফুট ৭ ইঞ্চি লম্বা ১টি বাঘের চামড়া, ২৪ খ্ল হাড় ২৯টি দাঁত এবং ১টি মাথা। দুঃসংবাদটি জানতে পেরে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়েছি তখন। যে মুহূর্তে বাঘ শুমারির কাজ চলছিল ঠিক তখনি বাঘ হারানোর সংবাদ সত্যি আমাদেরকে ভীষণ বিচলিত করেছে। উল্লেখ্য, তারও তিন মাস আগে র্যাব-৮ তিনটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা এমনিই অপ্রতুল। ২০০৪ সালের শুমারি অনুযায়ী বাঘের সংখ্যা মাত্র ছিল ৪৪০টি। তার মধ্যে ২১টি ছিল বাচ্চা বাঘ। অপরদিকে পুরুষ বাঘের সংখ্যা ছিল ১২১টি এবং স্ত্রী বাঘের সংখ্যা ছিল ২৯৮টি। বছর দশেকের মাথায় সেই সংখ্যা নেমে হয়েছে ১০৬টিতে। অর্থাৎ ২০১৫ সালের শুমারিতে মাত্র ১০৬টি বাঘের সন্ধান পাওয়া গেছে। কিন্তু ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘের অস্তিত্ব চিহ্নিত হয়েছে। সে হিসেবে তিন বছরের ব্যবধানে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে ৮ শতাংশ। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, শুধু সুন্দরবনেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই বাঘের সংখ্যা অপ্রতুল। মাত্র হাজার দুয়েক ডোরাকাটা বাঘের বাস রয়েছে সমগ্র বিশ্বে। যার কারণেই আইইউসিএন ২০১০ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী হিসেবে ঘোষণাও করেছে।

আমরা জানি, সুন্দরবনের (বাংলাদেশ অংশের) আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত অংশের আয়তন ৩৯৮৩ বর্গ কিলোমিটার। তার মধ্যে বাংলাদেশের অংশে মাত্র ১০৬টি বাঘের বাস রয়েছে, যা বড়ই বেমানান। এ সংখ্যাটি সুন্দরবনের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে মোটেও সুখকর সংবাদ নয় বরং বড়সড়ো একটা দুঃসংবাদ। তার ওপর যদি আমরা এভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে হারাতে থাকি, তাহলে ওদের সংখ্যা শূন্যের কোটায় পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়।

যেসব কারণে বাঘের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে— বাঘের জন্মহার কমে যাওয়া। তাছাড়া বাঘের বাচ্চাকে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বড় হতে হয়। প্রধান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় বাবা বাঘের নজর এড়িয়ে থেকে। ক্ষুধার্ত বাবা বাঘ, মা বাঘের কোল থেকে নিজ শাবককে ছিনিয়ে নিয়ে খেয়ে ফেলে। ফলে জন্ম নেয়া অনেক শাবক মাস খানেকের মাথায় হারিয়ে যায়। এর সঙ্গে যদি চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য যোগ হয়, তাহলে বিষয়টা কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বাঘেদের দুঃসময় চলছে এখন। বলা যায় অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ওরা। অস্তিত্ব সংকটের লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে সুন্দরবনে কোনোমতে বেঁচে আছে স্বল্প সংখ্যক বাঘ। সেই নিদারুণ সময়ে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তের সংবাদ জানতে পেরেছি আমরা। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে— পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীর নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। ইতিপূর্বে এ ধরনের অভয়ারণ্য ছিল মাত্র ২৩ শতাংশ এলাকা নিয়ে। বলা যায়, এটি বাঘ রক্ষার জন্য একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। উদ্যোগটি নেওয়ার ফলে শুধু বাঘই নয়, সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যও রক্ষা পাবে। হয়তো আগের মতো বাঘের সংখ্যা রাতারাতি বৃদ্ধি না পেলেও বেশ খানিকটা সহায়ক হবে সংখ্যা বৃদ্ধিতে।

এক্ষেত্রে প্রথমত নজর রাখতে হবে প্রতিপক্ষ বাবা বাঘের প্রতি। বাবা বাঘ যাতে তার শাবককে খেয়ে ফেলতে না পারে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে পারলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ধরনের বাধা থাকবে না। আরেকটি বিষয়েও নজর দিতে হবে, সেটি হচ্ছে অভয়ারণ্য রক্ষকদের প্রতি। যেন দুষ্কৃতিকারীর যোগসাজশে তারা বাঘের সর্বনাশ ঘটাতে না পারে। এ দুটি বিষয়ে সজাগ থাকতে পারলে হয়তো আমরা আবার সুন্দরবনের যত্রতত্র বাঘের বিচরণ দেখতে পাব।

 

লেখক : বন্যপ্রাণী বিশারদ

alamshine@gmail.com

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads