রোহিঙ্গা সঙ্কটের এক বছর পূর্ণ হলো আজ। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মুখে দেশটির রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বিপুলসংখ্যক এই জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে জাতীয় এবং স্থানীয় পর্যায়ে সীমাহীন সঙ্কটের মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। সঙ্কট উত্তরণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি এখনো। আন্তর্জাতিক সমালোচনা ও চাপের মুখে মিয়ানমার তার নাগরিকদের ফেরত নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করলেও সেই চুক্তির কোনো শর্তই এখন পর্যন্ত পূরণ করেনি দেশটি। শুরুর দিকে কয়েক মাস প্রত্যাবাসন নিয়ে জোর কথাবার্তা হলেও গত তিন মাসে এ নিয়ে আলোচনা যেন থমকে গেছে। এখন তাই রোহিঙ্গারা একটা বিষয়ে অনেকটা নিশ্চিত যে, সহসাই রাখাইনে ফেরা হচ্ছে না তাদের। এখন বাংলাদেশকেই তাদের স্থায়ী ঠিকানা মনে করতে শুরু করেছে এই উদ্বাস্তু মানুষেরা।
এ পরিস্থিতিতে ৭ হাজার একরের বেশি জমিতে থাকা ১১ লাখ ৬ হাজার ২৬৪ জন রোহিঙ্গা নিয়ে চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কারণ রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে জড়িয়ে পড়েছে হত্যা, ধর্ষণ, মাদক পরিবহন ও ব্যবসা, পোনা নিধন, পাহাড়-গাছ নিধনসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে। দখল করেছে স্থানীয় শ্রমবাজারও। সৃষ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক-সামাজিক সঙ্কটও।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলো নিয়ে কথা হয় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। বাংলাদেশের খবরের কাছে সমস্যাগুলোর গভীরতা তুলে ধরে এ বিষয়ে খোলামেলা কথা বলেন তারা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর সম্ভাব্য সময় সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সদস্য মো. আবুল কালামের কাছে। তিনি বলেন, মিয়ানমার সরকার এখন তো উল্টো আমাদের দোষারোপ করছে। এ থেকে বোঝা যায়, সহসাই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হচ্ছে না। যদিও শুনছি তারা (মিয়ানমার) ইউএনএইচসিআরসহ কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে চুক্তি করছে। তবে কোনো কিছুই স্পষ্ট নয়। তবে আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত আছে।
উখিয়া উপজেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সভাপতি নূর মোহাম্মদ সিকদার এ প্রসঙ্গে বলেন, রোহিঙ্গারা আর ফিরছে না সেটা অনেকটা নিশ্চিত। কারণ তাদের ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়দের ক্ষতি হলেও এনজিগুলোর লাভ হচ্ছে মন্তব্য করেন তিনি। আমার মতে, এখানে কর্মরত প্রায় ২৩৩টি এনজিও মধ্যে বেশির ভাগই সেবার পাশাপাশি প্রতারণা করে ফায়দা লুটছে।
একই অভিযোগ করেন টেকনাফ কৃষক লীগ নেতা আবুল হোসেন রাজুও। তিনি আরো যোগ করেন, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে ইতোমধ্যে ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিয়েছে। সামনের দিনে এ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়তেই থাকবে। তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে সেটা কেউ ভাবছে না।
এদেশে স্থায়ীভাবে থেকে যাওয়ার বাসনা ফুটে উঠেছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১২ নং ব্লকের মাঝি আবদুর রশিদের বক্তব্যে। তিনি বলেন, আমি এদেশে এসেছি ১৩ বছর আগে। আমরা বার্মায় ফিরে যেতে চাই, কিন্তু সেখানে বসবাসের কোনো পরিবেশ নেই। তাই বাংলাদেশকেই আমরা নিরাপদ মনে করছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নিকারুজ্জামান বলেন, এত বিপুলসংখ্যাক রোহিঙ্গার চাপে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ হচ্ছে। সে জন্য এখন থেকে সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি যুক্ত করেই প্রকল্প ছাড় দেওয়া হচ্ছে। আমরা চাইছি উভয়পক্ষই সুন্দরভাবে থাকুক।
উখিয়া টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে এক বছর, এটা আনুষ্ঠানিক কথা। আসলে তাদের বাংলাদেশে আসা শুরু ১৯৮০ সালের পর থেকে। বহু রোহিঙ্গা আমাদের জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে গেছে। আর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি দেখতে পাচ্ছি না। ফলে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হচ্ছে এবং সামনে আরো হতে পারে। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক প্রভাবশালী দেশ আমাদের ধন্যবাদ দেয়, আশ্বাস দেয় রোহিঙ্গাদের ফেরাতে তারা সহযোগিতা করবে। কিন্তু কোথায়, কী ধরনের সহযোগিতা করছে, সেটা পরিষ্কার করে কেউ বলে না। আমার বলতে দ্বিধা নেই, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজুহাত তুলে অনেক দেশে সামরিক হামলা চালানো হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও মিয়ানমারের ওপর কেন কোনো চাপ দিতে পারছে না পশ্চিমা দেশগুলো? তাদের উদ্যোগ শুধু গোলটেবিল বৈঠক পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
এখন আর রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে চিন্তা করেন না জানিয়ে টেকনাফ পৌর মেয়র হাজি ইসলাম বলেন, এখন চিন্তা করি তাদের হাত থেকে কীভাবে আমাদের নাগরিকদের বাঁচানো যায়? রোহিঙ্গারা আজকে নয়, প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে আমাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে আসা রোহিঙ্গারা এখন উখিয়া, টেকনাফসহ কক্সবাজারের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন আসছে, সেখানেও হয়তো অনেকে তাদের সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, ডাকাতি, রাহাজানি, চুরি, মাদক পরিবহন, জমি দখল করাসহ সব অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গাদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া এবং এক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার ড. এ কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইতোমধ্যে ১৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া অপহরণের ঘটনায় তিনটি, মাদক সংক্রান্ত ৫৮টি, ধর্ষণ সংক্রান্ত ২টি, ফরেন অ্যাক্টে ৪০টি, চোরাচালানে ৫টি, চুরি সংক্রান্ত ১টি, ডাকাতি প্রস্তুতি ৫টি এবং অন্যান্য অপরাধে ২২টি মামলা হয়েছে।
একসঙ্গে এত বেশি রোহিঙ্গাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই দুরূহ কাজ মন্তব্য করে তিনি বলেন, তবু আমরা সার্বক্ষণিক ৫টি স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প, এছাড়া প্রতিটি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে একটি করে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনই বাংলাদেশ সরকারের প্রথম লক্ষ্য জানিয়ে এ ব্যাপারে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, আমাদের তো সামর্থ্যের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। কতদিন আমরা এই বিপুলসংখ্যক মানুষের বোঝা টানতে পারব? অতীতেও অনেক দেশের সরকারপ্রধান বা আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব কক্সবাজারে এসেছেন। সবাইকে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসনকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে বোঝানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা মিয়ানমারকে চাপ দিচ্ছে। ফলে মিয়ানমার আগের মতো বাঁকা পথে নেই। আশা করি, খুব দ্রুত একটি সুন্দর পথে হাঁটব আমরা।
গত বছরের ২৫ আগস্ট সন্ত্রাসী হামলার অজুহাত তুলে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ নির্যাতন চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের মুখে কক্সবাজারের ১২টি পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমায় মুসলিম এ জনগোষ্ঠীর ৭ লাখ সদস্য। আগে আসা রোহিঙ্গাসহ এ সংখ্যা এখন ১১ লাখ ৬ হাজার ২৬৪ জন। নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত সর্বস্ব হারানো এই মানুষদের ঠিকানা এখন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে নির্মিত আশ্রয় শিবিরের খুপড়ি ঘর।