কে চালায় এই বিশ্ব- নারী না পুরুষ? কবি নজরুল বলেছিলেন, বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। বর্তমান বিশ্বে নারী চলছে পুরুষের সঙ্গে পা মিলিয়েই, সমানতালে। রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতির বিভিন্ন অঙ্গনে নারী রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বর্তমান প্রযুক্তি ও করপোরেট বিশ্বে নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। বর্তমান বিশ্বে এমন অনেক ক্ষমতাধর নারী আছেন, যিনি অন্য কোনো ক্ষমতাধর পুরুষের সঙ্গে সমানতালে পা মেলাতে সক্ষম। যেমন জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মেরকেল, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শার্লি সেন্ডবার্গ, আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দ। তাদের ভূমিকা শুধু স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নয়, বরং সারা বিশ্বে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বিশ্ববিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন প্রতিবছরই বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে। নারীদের জন্যও তারা আলাদাভাবে একটি সেগমেন্ট করে। ২০১৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিন যে ১০০ ক্ষমতাধর নারীর তালিকা প্রকাশ করেছে, তাদের মধ্যে প্রথম ১০ জনকে নিয়ে এ আয়োজন।
তালিকাটি করা হয়েছে সাতটি বিষয়কে ‘ক্ষমতার ভিত্তি’ ধরে। যেমন বিলিয়নিয়ার, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, দানবীর বা স্বেচ্ছাসেবী এবং প্রযুক্তিবিদ। এই সাত ক্ষেত্রে যারা প্রভাব বিস্তার করে চলেছেন, তাদেরই রেটিং ধরে প্রস্তুত করা হয়েছে ক্ষমতাধরদের তালিকা।
১. অ্যাঞ্জেলা মেরকেল
গত বছর চতুর্থবারের মতো জার্মানির চ্যান্সেলর নির্বাচিত হয়েছেন। তিনিই জার্মানির প্রথম নারী চ্যান্সেলর। প্রথমবার নির্বাচিত হয়েছিলেন ২০০৫ সালে। সেই থেকে এখনো ক্ষমতায় আছেন। ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকেই নির্বাচিত করেছে বিশ্বের প্রথম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে। তার যথেষ্ট কারণও আছে। বর্তমান বৈশ্বিক রাজনীতিতে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত তাকে ভয় পেয়ে চলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, সমস্ত ন্যাটো শক্তি এখন একা মেরকেলই চালায়। ট্রাম্পের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক। আর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁকে তো তার ঘরের মানুষই বলা যায়। শুধু সে কারণেই নয়, ১৫ লাখ মুসলিম শরণার্থী নিজ দেশে আশ্রয় দিয়ে তিনি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। সব পশ্চিমাশক্তি যখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তখন তিনি মুসলমানদের বন্ধু হিসেবে এগিয়ে এসেছেন। যুদ্ধের কারণে ইরাক ও সিরিয়া থেকে উদ্বাস্তু হওয়া মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন নিজ দেশে। কঠোর সমালোচনা করেছেন মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আগ্রাসনের। ইউরোপীয় সঙ্কট মোকাবেলায় তার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তিনি কোয়ান্টাম মেকানিকস নিয়ে ডক্টরেট করেছিলেন। জন্মেছেন ১৯৫৪ সালের ১৭ জুলাই তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে। ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি যখন হুমকির মুখে, তখন জার্মানিতে নতুন বিপ্লবের শুরু, বার্লিন দেয়ালের পতন। সে সময়ই মেরকেলের রাজনীতিবিদ হিসেবে উত্থান শুরু। ফোর্বস ম্যাগাজিন টানা সপ্তমবারের মতো মেরকেলকে বিশ্বের ক্ষমতাধর নারী হিসেবে নির্বাচিত করেছে, আর এই সম্মান তিনি পেয়েছেন মোট ১২ বার।
২. থেরেসা মে
থেরেসা মে যুক্তরাজ্যে দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। তার আগে মার্গারেট থ্যাচার প্রথম নারী, যিনি ব্রিটেনের সরকারপ্রধান ছিলেন। ২০১৬ সালে থেরেসা মে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। তখন তার মেয়াদ ছিল ২০২০ সাল পর্যন্ত। কিন্তু ব্রেক্সিট ইস্যুকে কেন্দ্র করে নানা জটিলতা সৃষ্টি হলে তিনি ২০১৭ সালে আগাম নির্বাচন ডাকেন। তখন তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, যদিও সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে যায়। থেরেসা মে জন্মগ্রহণ করেন ইংল্যান্ডের সাসেক্সের ইস্টবোর্নে, ১৯৫৬ সালের ১ অক্টোবর। অক্সফোর্ডের সেন্ট হিউ কলেজ থেকে ১৯৭৭ সালে ভূগোলে তিনি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর প্রায় ২০ বছর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত লন্ডন বারো অব মর্টনে কাউন্সিলর হন। ১৯৯৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে পশ্চিম লন্ডনের মেইডেনহেডের পক্ষে তিনিই প্রথম নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) ছিলেন। ১৯৯৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের ছায়া কেবিনেটের সদস্য ছিলেন থেরেসা। ২০০২ সালে কনজারভেটিভ পার্টির প্রথম নারী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকা নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে তিনি হঠাৎ রাজনীতির মাঠে প্রথম সারিতে চলে আসেন। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেডিভ ক্যামেরন ইইউতে থাকার পক্ষে ছিলেন। এ নিয়ে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। জনগণ ব্রেক্সিটের পক্ষে রায় দেয়। পরাজয় মেনে নিয়ে ডেডিভ ক্যামেরন পদত্যাগ করেন। তখন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অনুরোধে থেরেসা মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৩. মেলিন্ডা গেটস
বিল গেটসকে সবাই চেনেন। বিশ্বের ১ নম্বর ধনী। মেলিন্ডা গেটসকে ক’জন চেনেন? হ্যাঁ, তিনি বিল গেটসের সহধর্মিণী। কিন্তু শুধু বিল গেটসের স্ত্রী হিসেবেই নয়, নিজেরও আছে অনন্য পরিচয়। তিনি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম এক মানবপ্রেমী। স্বামীকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা সারা বিশ্বে শিক্ষায় ও স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। বিল গেটসের আয়ের বেশিরভাগ অংশই চলে যায় মানবসেবায়। মেলিন্ডা গেটস এ ফাউন্ডেশনের পরিচালক। মাইক্রোসফটে কর্মরত থাকার সময়ই বিল গেটসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তিনি সেখানে মাল্টিমিডিয়া প্রকল্পের নানা উন্নয়নমূলক কাজ করতেন। ১৯৮৭ সালে তিনি মাইক্রোসফটে যোগদান করেছিলেন। ১৯৯৪ সালে বিল গেটসের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়েটা প্রথমে গোপনই ছিল। পরে তা প্রকাশ হয়। বিয়ের পর তিনি মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে পরিবার দেখাশোনায় মনোনিবেশ করেন। এর মধ্যে তাদের প্রথম সন্তান জেনিফারের জন্ম হয় ১৯৯৬ সালে। ২০০০ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করেন বিল-মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন। শুধু স্বাস্থ্য বা শিক্ষাসেবাই নয়, নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তিনি সোচ্চার। নারীদের প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য তিনি কাজ করছেন। তার কাজের ক্ষেত্র ছড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার গরিব দেশগুলোতেও। ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে জন্মগ্রহণ করা মেলিন্ডার পুরো নাম মেলিন্ডা ফ্রেঞ্চ গেটস। একজন মানবদরদী ও সমাজসেবী হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে।
৪. শার্লি স্যান্ডবার্গ
ফেসবুকের চিফ কো-অপারেট অফিসার শার্লি স্যান্ডবার্গ ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে ২০১৭ সালে হয়েছেন বিশ্বের চতুর্থ ক্ষমতাধর নারী। এর আগেও তিনি টাইম ম্যাগাজিন ও ফোর্বস ম্যাগাজিনের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ১০ নম্বরের মধ্যেই ছিলেন। ২০০৮ সালে তিনি ফেসবুকে যুক্ত হন। তিনিই প্রথম নারী, যিনি ফেসবুকের পরিচালনা পর্ষদে আছেন। এর আগে তিনি ছিলেন গুগলের ভোগ্যপণ্য বিক্রেতা। তিনিই প্রথম গুগলে বই অনুসন্ধান বিভাগ চালু করেন। গুগলের সার্চ ইঞ্চিন চালু করতে তার ভূমিকা ছিল ব্যাপক। ফেসবুকে তিনি সেলস, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স, পাবলিক পলিসি এবং কমিউনিকেশন নিয়ে কাজ করেন। ২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর টেডএক্স সন্মেলনে এক বক্তৃতায় স্যান্ডবার্গ বলেন, ‘আমরা বর্তমান সময়ের নারীরা খুবই ভাগ্যবান। দারুণ এক বিশ্বে বাস করি আমরা। এমন বিশ্ব আমাদের নানি-দাদি কিংবা বাবা- মায়েরাও পাননি। তখন নারীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ ছিল সীমিত। আজকে উপস্থিত সবাই কমবেশি অধিকারের স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। এতকিছুর পরেও নারীরা প্রফেশনের জায়গায় এখনো নিজের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।’ নারী নেতৃত্ব এবং নারীদের প্রযুক্তি খাতে এগিয়ে আনার জন্য তিনি কাজ করছেন। ৪৯ বছর বয়সী শার্লি স্যান্ডবার্গ এখনো চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। তার অপূর্ব হাসি ভুবনবিখ্যাত। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে তার জন্ম। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ডিগ্রি অর্জন করেন, পরে হার্ভার্ড থেকেই এমবিএ সম্পন্ন করেন। নিজের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দুটি বইও লিখেছেন। দ্বিতীয় স্বামী ডেভ গোল্ডবার্গ ২১০৫ সালে মারা যাওয়ার পর বর্তমানে তিনি মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন ক্যালিফোর্নিয়ায়।
৫. ম্যারি টেরেসা বেরা
ম্যারি টেরেসা বেরা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরসের সিইও এবং চেয়ারম্যান। তিনিই প্রথম নারী, যিনি কোনো বৃহৎ গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানে এত বড় দায়িত্ব পেলেন। ২০১৪ সাল থেকে তিনি এই পদ অধিকার করে আছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান অঙ্গরাজ্যের ডেট্রয়েটে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গাড়ি নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান জেনারেল মোটরস (জিএম) প্রতিষ্ঠা করা হয় ২০০৮ সালে। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখায় বর্তমানে প্রায় ৩ লাখ কর্মী কর্মরত আছেন এই প্রতিষ্ঠানের আওতায়। সেই প্রতিষ্ঠানের একজন প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে টেরেসার প্রভাব সহজেই অনুমান করা যায়। ২০১৭ সালে শুধু চীনেই প্রতিষ্ঠানটি বিক্রি করেছে ৪ মিলিয়ন গাড়ি। ২০১৭ সালে ২২ মিলিয়ন ডলার আয় করে বেরা আরো তিনটি বৃহৎ গাড়ি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে পেছনে ফেলে দেন। শুধু ব্যবসায়ী নন, সমাজসেবী হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে ডিগ্রি সম্পন্ন করে জেনারেল মোটরসের একটি ফেলোশিপ নিয়ে তিনি বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। তার জন্ম ১৯৬১ সালের ২৪ ডিসেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। তিনি এ পর্যন্ত বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছিলেন, পরে সেখান থেকে সরে এসেছেন। তিন চার বছর ধরেই ফোর্বস, টাইম, ফোরচুনের মতো প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো তাকে একশ ক্ষমতাধর নারীর তালিকায় রাখছে। ২০১৭ সালে তিনি প্রথমবারের মতো পঞ্চম ক্ষমতাধর নারী হিসেবে নির্বাচিত হন। তার স্বামী টনি বেরাও একজন বড় ব্যবসায়ী।
৬. সুজান ওজোকি
ইউটিউব ছাড়া এখন আমাদের এক মুহূর্ত চলে না। যে কোনো গান, ফিল্ম, লেকচারের ভিডিও দেখতে গেলেই আমরা প্রথমে ইউটিউবে সার্চ দিই। সেই বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী সুজান ওজোকি। ফোর্বসের তালিকায় তিনি হয়েছেন বর্তমান বিশ্বের ষষ্ঠতম ক্ষমতাধর নারী। মজার ব্যাপার, প্রযুক্তিবিদ হিসেবে এখন তার পরিচয় গড়ে উঠলেও প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন একজন সাহিত্যিক। ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন লেখালেখি করার। সে জন্য পড়াশোনাও করেছেন সাহিত্য নিয়ে। তার মা একজন সাংবাদিক এবং বাবা অধ্যাপক। কলেজে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেন অর্থনীতিতে, ১৯৯৩ সালে। তারপর দ্বিতীয়বার মাস্টার্স করেন ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে, ১৯৯৮ সালে। তখনো তিনি মনোস্থির করতে পারেননি ভবিষ্যতে কী হবেন! উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, চেয়েছিলেন যা-ই করেন নিজেকে সর্বোচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করবেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৯৯ সালে গুগলে যোগ দেন প্রথম মার্কেটিং ম্যানেজার হিসেবে। খুব দ্রুত তিনি নিজের দক্ষতার পরিচয় দিয়ে সুনাম অর্জন করলেন। এ সময় তিনি গুগল বোর্ডকে ইউটিউব কেনার পরামর্শ দেন। খুব অল্প পরিসরে তখন গুগলের সঙ্গে ইউটিউবের যাত্রা শুরু। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুজান হয়ে যান ইউটিউবের প্রধান। সুজানকে ধরা হয় বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে। ব্যক্তিজীবনে পাঁচ সন্তানের জননী সুজান বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নারী হিসেবে ফোর্বস ম্যাগাজিনে জায়গা করে নিয়েছিলেন ২০১১ সালে। তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫০ সালের ৫ জুলাই, যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায়।
৭. আম্বিগেল জনসন
মার্কিন ধনকুবের ব্যবসায়ী নারী আম্বিগেল জনসন ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে বর্তমান বিশ্বের সপ্তম ক্ষমতাধর নারী। তিনি বিশ্ববিখ্যাত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ফাইডালিটি ইনভেস্টমেন্টসের বর্তমান চেয়ারম্যান। এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছিলেন তার দাদা দ্বিতীয় এডওয়ার্ড জনসন, পরে তার বাবা তৃতীয় নেড জনসন এর হাল ধরেছিলেন। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন আম্বিগেল জনসন। ২০১৩ সালে আম্বিগেল কোম্পানির ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ শেয়ার নিজের দখলে রাখেন। তার সম্পদের পরিমাণ বর্তমানে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৬ সালে বাবার অবসরের পর তিনি প্রতিষ্ঠানটির পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেন। তিনি একাধারে প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট, সিইও এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সারা বিশ্বে বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের আওতায় ৩৬ হাজার কর্মচারী কর্মরত আছেন। ব্যবসায়িক জগতের বাইরে খুব অল্প মানুষই তার নাম জানতো। ফোর্বসের জরিপে ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় চলে আসার পর থেকে সারা বিশ্বে তার পরিচিতি গড়ে উঠেছে। শুধু ব্যবসায়িক হিসেবেই নয়, নানা সামাজিক কাজেও তিনি অবদান রাখছেন। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৬১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল থেকে এমবিএ সম্পন্ন করে তিনি বাবার কোম্পানিতে কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৮০ সাল থেকে। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দার পর ফাইডালি বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিল কয়েক বছর। আম্বিগেল পরিচালনার হাত ধরে কোম্পানিকে আবার টেনে তোলেন অতল থেকে। কদাচিৎ তিনি সাক্ষাৎ দিতে আসেন, তাই তার সম্পর্কে বেশিকিছু জানা যায় না। কাজপাগল আম্বিগেল দশ-বারো ঘণ্টা অফিস সামলে সরাসরি বাসায় চলে যান, বাকি অবসর সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে ভালোবাসেন।
৮. ক্রিস্টিন লাগার্দ
ক্রিস্টিন লাগার্দ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর প্রধান নির্বাহী। ফোর্বস ম্যাগাজিনের জরিপে তিনি বিশ্বের অষ্টম ক্ষমতাধর নারী নির্বাচিত হয়েছেন। তিনিই প্রথম নারী, যিনি আইএমএফের প্রধান হিসেবে এই গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে আসীন হলেন। এর মাধ্যমে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন ১৮৯টি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে। নিঃসন্দেহে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ। আইএমএফ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালে। তখন থেকে শুধু পুরুষরাই এর প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এই প্রথম একজন নারী এমন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হওয়ায় এটি নারীদের জন্য একটি বিশাল বিজয়। ক্রিস্টিন লাগার্দ ফ্রান্সের নাগরিক। তিনি সেখানে একজন স্বনামধন্য আইনজীবী ছিলেন। ২০০৭ সালে ফ্রান্সের অর্থমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি আইএমএফের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার আগে এ দায়িত্বে ছিলেন ডমিনিক স্ট্রাউস কান। তার বাড়িও ফ্রান্স। যৌন হয়রানির অভিযোগে পদত্যাগ করায় ক্রিস্টিন লাগার্দ দায়িত্ব নেন। ২০১৬ সালে তার বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল। অর্থমন্ত্রী থাকাকালে তিনি ফ্রান্সের এক ব্যবসায়ীকে বিপুল অঙ্কের টাকা ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাইয়ে দিয়েছিলেন। পরে এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ২০১৬ সালে ক্রিস্টিন লাগার্দ দ্বিতীয়বারের মতো আইএমএফের প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। বর্তমানে তার বয়স ৬২। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি ফ্রান্সের প্যারিসে। নানা সীমাবদ্ধতা, বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে তিনি দক্ষ হাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল রাখার জন্য কাজ করেছেন। তার ওপর আস্থা প্রকাশ করেছে বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
৯. আনা পেত্রিকা বতিন
২০০৫ সালে তিনি ফোর্বসের ক্ষমতাধর নারীদের তালিকায় ৯৯তম অবস্থানে ছিলেন। ২০০৯ সালে হলেন ৪৫তম। ২০১৬-১৭ সালে তিনি নিজেকে ১০ নম্বরের মধ্যে নিয়ে এলেন। আনা পেত্রিকা বতিন, বর্তমানে বিশ্বের নবম ক্ষমতাধর নারী। তিনি স্পেনের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান। সারা বিশ্বের ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফোর্বসের তালিকায় স্ট্যান্ডার্ড কোম্পানি ৩৭তম। স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক স্পেনের সর্ববৃহৎ ব্যাংক, সমগ্র ইউরোপে ব্যাংকটির অবস্থান পঞ্চম। শুধু ইউরোপ নয়, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকাসহ এশিয়ার কয়েকটি দেশের অর্থব্যবস্থাও এ ব্যাংকটি নিয়ন্ত্রণ করে। সিঙ্গাপুর, হংকং ও আফ্রিকায় ব্যাংকটি ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। ১৬১ বছর আগে, ১৮৫৭ সালে স্পেনের স্ট্যান্ডার্ড শহরে ব্যাংকটি গড়ে উঠেছিল। তাকে বলা হয় এই ব্যাংকটির দায়িত্বে নিয়োজিত চতুর্থ প্রজন্মের প্রতিনিধি। তার আগে তার বাবা এলিলিও বতিন ছিলেন এই ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান। অর্থনীতিতে পড়াশোনা শেষ করে আনা পেত্রিকা এ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার আগে আমেরিকার স্বনামধন্য ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান জিপি মর্গানে কাজ করে এসেছেন আট বছর। ২০১৩ সালে তিনি কোকা-কোলা কোম্পানি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে যোগ দিয়ে এ পর্যন্ত তিনি সুনামের সঙ্গেই দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। স্পেনের রাজনৈতিক অস্থিরতার কালেও তিনি দক্ষ হাতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করেছেন। তার জন্ম ১৯৬০ সালের ৪ অক্টোবর স্পেনের স্ট্যান্ডার্ড শহরে। ৫৮ বছর বয়সী আনা পেত্রিকা বতিন ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জননী।
১০. জিনি রোমেটি
বিশ্বে নারী প্রধান নির্বাহীদের মধ্যে গত বছর সবচেয়ে বেশি আয় করেছেন ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস মেশিনস করপোরেশনের (আইবিএম) সিইও ভার্জিনিয়া রোমেটি। আমেরিকান এই প্রভাবশালী নারীকে জিনি রোমেটি নামে ডাকা হয়। তিনি আইবিএমের প্রেসিডেন্ট এবং চেয়ারম্যানও। ২০১৬ সালে রোমেটি আয় করেছেন ৩২ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। জিনি রোমেটি প্রতিষ্ঠানটির প্রথম নারী চেয়ারম্যান। আন্তর্জাতিক ব্যবসায়িক পরিমণ্ডলে তার ক্ষমতা ব্যাপক। ফোরচুন ও টাইমস ম্যাগাজিনের জরিপেও তিনি ক্ষমতাধর নারী হিসেবে বেশ কয়েক বছর ধরে ২০ জনের মধ্যে অবস্থান করছেন। জিনি রোমেটি ১৯৫৭ সালের ২৯ জুলাই শিকাগোতে জন্মগ্রহণ করেন। কম্পিউটার সায়েন্স এবং ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি জেনারেল মোটরসের ফেলোশিপে একটি ডিগ্রি সম্পন্ন করেছিলেন। জেনারেল মোটরসে সিস্টেম ডেভেলপমেন্টে কিছুদিন কাজ করে ১৯৮১ সালে আইবিএমে প্রথম যোগ দেন সিস্টেম অ্যানালিসিস্ট হিসেবে। প্রথম ১০ বছর আইবিএমে একজন প্রযুক্তিবিদ হিসেবেই তিনি কাজ করেন। নিউইয়র্ক টাইমস তাকে নিয়ে লিখেছিল, কীভাবে প্রযুক্তিক্ষেত্র দ্রুত ব্যবস্থাপনার কেন্দ্রে আনতে হয়, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ জিনি রোমেটি। ২০০০ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে তিনি আইবিএমকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নেতৃত্বের অবস্থানে নিয়ে আসেন। এরপর ২০১২ সাল থেকে তিনি কোম্পানির সিইও, প্রেসিডেন্ট, চেয়ারম্যান সব দায়িত্বই পালন করছেন। তার সামনে যেন আকাশে ওড়ার একটা সিঁড়ি খুলে গেল, আর তিনি একেক ধাপে আরো উচ্চ অবস্থানে উঠতে লাগলেন। ফোর্বস ম্যাগাজিন তাকে দশম ক্ষমতাধর নারী নির্বাচিত করে বিশ্বের নারীদের এই ইঙ্গিতই দিতে চায়- স্বপ্ন মানুষকে পিছু হটাতে পারে না।