বটগাছের ইতিকথা

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

বটগাছের ইতিকথা

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ২৪ মে, ২০১৯

বটগাছকে আশ্রয় বা ভরসার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সম্ভবত এ কারণেই বটগাছের সঙ্গে পরিবারের প্রধানকে তুলনা করা হয়ে থাকে। বটগাছ বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম এবং মানুষ, পাখি, কীটপতঙ্গের অকৃত্রিম বন্ধু। আবহমান বাংলার গ্রামীণ জনপদে পথের ধারে, নদীর পাড়ে, হাটে অথবা জনবিরল স্থানে খোলা ময়দানে ডাল-পাতায় পরিপূর্ণ বটগাছ পথিকের বিশ্রামের আশ্রয়স্থল ছিল। সেসব বটগাছকে ঘিরে জমে উঠত মানুষের বিশ্রাম-আড্ডা, বিনোদন, সভা-সমাবেশ, মেলা ও হাটবাজার। সময়ের বিবর্তনে বটগাছের এই জনবান্ধব ঐতিহ্য অনেকটাই বিলুপ্ত হলেও গ্রামীণ জনপদে এখনো টিকে আছে অনেক শতবর্ষী বটগাছ এবং তার নানা গল্পকাহিনী।

বটগাছের সঙ্গে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। অশ্বত্থ, অশথ বা পিপল বা বটগাছের বৈজ্ঞানিক নাম Ficus religiosa, যাকে ইংরেজিতে 'sacred fig' বলা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি পবিত্র গাছ, পূজা করা হয় এই গাছে। বটগাছ এমনিতেই বড়। বিশাল জায়গা নিয়ে এ গাছ তার ডালপালা বিস্তৃত করে। বটগাছ একপ্রকার বট বা ডুমুরজাতীয় বৃক্ষ, যার আদি নিবাস বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ-পশ্চিম চীন এবং ইন্দোচীন প্রভৃতি স্থানে। অন্য গাছের চেয়ে বটগাছে পাতা বেশি থাকে। তাই সালোকসংশ্লেষণের সময় অন্য গাছের চেয়ে বাতাস থেকে বেশি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ফিরিয়ে দেয়। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একটি প্রমাণ বয়সের বটগাছ দৈনিক গড়ে ৫০-৭০ গ্যালন জলীয় বাষ্প ছাড়ে, যা স্থানীয় এলাকার আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে। মূল গাছ এবং গাছের ঝুরির শিকড় অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে বিস্তীর্ণ এলাকার মাটি আঁকড়ে রাখে। ভূমিক্ষয় রোধ করে। বসন্ত ও শরৎকালে বটগাছে নতুন পাতা গজায়। কচি পাতার রঙ উজ্জ্বল সবুজ থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে বটের ফল পাকে। বটগাছের মঞ্জরির গর্ভে খুবই ছোট এবং ফলের মতোই গোলাকার ফুলগুলো লুকানো থাকে। একলিঙ্গিক এই ফুলগুলো পরাগায়ণের জন্য বিশেষ জাতের পতঙ্গের ওপর নির্ভরশীল। পাখিরা ফল এই খেয়ে বীজ ছড়িয়ে দেয় বিভিন্ন স্থানে। পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরনো দালানের ফাটল ও অন্য কোনো গাছের কোটরে সহজেই অঙ্কুরিত হয়ে বেড়ে ওঠে বটবৃক্ষ। সম্ভবত এ কারণে উপগাছা বা পরগাছা হিসেবেও পরিচিতি আছে বটগাছের।

এশিয়ার বৃহত্তম বটগাছ বাংলাদেশে : বিবিসির জরিপে ১৯৮৪ সালে এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম খ্যাত এ বটগাছের অবস্থান ও নামকরণ নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা এবং রয়েছে কিংবদন্তির গল্প। কারো কাছে সুইতলার বটগাছ, কারো কাছে সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছ আবার কারো কাছে বেথুলীর বটগাছ বলে এটি পরিচিত। বিবিসির জরিপে একে এশিয়ার সবচেয়ে বড় বটগাছ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ৮ নম্বর মালিয়াট ইউনিয়নের বেথুলী মৌজায় সুইতলা মল্লিকপুরের বটগাছটি দেখলে যে কারো মন কাড়বে। গাছটি মোট ৪৫টি উপবৃক্ষ ও ১২ দাগে প্রায় ১১ একর (২.৩৩ হেক্টর) জমি দখল করে দাঁড়িয়ে আছে। গাছটির উচ্চতা আনুমানিক ২৫০ থেকে ৩০০ ফুট। বটগাছটি ৫২টি বটগাছে রূপ নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব পাশের গাছগুলো জমাটবদ্ধ এবং উত্তর-পশ্চিম পাশে কিছুটা ফাঁকা ছাউনি দিয়ে বেষ্টিত। গাছটির ৩৪৫টি ঝুরি মাটির সঙ্গে সংযুক্ত এবং ৩৮টি ঝুরি ঝুলন্ত অবস্থায়। মূলগাছটি এখন আর নেই। মাঝখানে কিছু অংশ ফাঁকা এবং চারপাশে শাখা-প্রশাখায় ঘেরা। গাছটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণাপ্রসূত গল্প প্রচলিত থাকলেও বয়োজ্যেষ্ঠ অধিকাংশের মতে, এ গাছটি প্রায় দুইশ থেকে তিনশ বছর পুরনো বলে ধারণা করা হয়। বটগাছটি কেন্দ্র করে পাশেই বাংলা ১৩৬০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বেথুলী বা মল্লিকপুরের বাজার। বটতলায় কালীপূজার জন্য একটি স্থায়ী পিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। গাছটি কে বা কারা লাগিয়েছে, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা যায় না। তবে প্রচলিত গল্প থেকে যতদূর জানা যায়, একসময় এখানে কুমারদের বসতি ছিল। কুমার পরিবারের কুয়োর মধ্যে এই বটগাছটির জন্ম। স্থানীয়দের মুখে মুখে গাছটি কিছু গল্প-গুজব রয়েছে যে বেশ কয়েক বছর আগে কুদরতউল্লা নামে একজন গাছের ডাল কেটে অসুস্থ হলে তার রক্তবমি শুরু হয়। কুদরতের স্ত্রী বটগাছ আগলে ধরে কান্নাকাটি করে স্বামীর প্রাণ ভিক্ষা চাইলে তার স্বামী সুস্থ হয়ে ওঠেন! তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৮২ সালের আগ পর্যন্ত এশিয়া মহাদেশের মধ্যে বৃহত্তম বটগাছ বলে পরিচিতি ছিল কলকাতার বোটানিক্যাল গার্ডেনের একটি গাছ। পরবর্তী সময়ে বিবিসির এক তথ্যানুষ্ঠান প্রতিবেদনে প্রচার হয়- ‘মল্লিকপুরের বটগাছই এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম। ১৯৯৮ সালের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় সেখানে একটি ফুলের বাগান তৈরি করা হয়। বটগাছের চারপাশ ঘিরে প্রাচীর নির্মাণের ব্যবস্থাও করেন তিনি। ঝিনাইদহ জেলা পরিষদ ১৯৯০ সালে বটগাছের পাশে একটি রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে। এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তর বটগাছের ঐতিহাসিক দিক বিবেচনা করে অনেক স্থান থেকে প্রতিনিয়ত দর্শনার্থীরা আসেন। বটগাছটির দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পাখ-পাখালির কলরব, ছায়াঘেরা শীতল পরিবেশ দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে।

বটগাছের রয়েছে আয়ুর্বেদিক গুণাগুণ : আয়ুবের্দ মতে, বটগাছের ছাল মধুমেহ রোগ সারাতে কাজে লাগে। বটগাছের দুধ দাঁতের যন্ত্রণায় খুব কাজে দেয়। বটছালের গুঁড়ো, গোলমরিচ, ক্ষাদিরা (আয়ুর্বেদিক গুঁড়ো) দিয়ে দাঁতের পেস্ট তেরি করলে দাঁতের পাইরিয়াসহ অনেক রোগ চলে যায়। বহুমূত্র অসুখে বটের বিচির গুঁড়ো দুধের সঙ্গে খেলে ব্যাপক কাজে দেয়। বটের ঝুড়ির গুঁড়ো তালমিছরি ও দুধ দিয়ে খাওয়ালে ডায়রিয়া সারে। বটের পাতা জ্বালাপোড়া, চুলকানির হাত থেকে বাঁচাতে সহায়তা করে।

বটবৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি : উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মতে, একটি বটগাছ কাটার সঙ্গে সঙ্গে ৩ শতাধিক প্রজাতির আবাস নষ্ট হয়। তাই আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে পরিবেশবান্ধব বিশাল আকৃতির বটগাছকে রক্ষা করতে হবে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদের স্মৃতিস্মারক হিসেবে দেশব্যাপী ‘মুক্তিবৃক্ষ’ ব্র্যান্ড নামে ত্রিশ লাখ বটবৃক্ষ রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সামাজিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ ২১-৪১ সোসাইটি’।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads