বঙ্গ রাখালের কবিতা ও আমার বোধ

বঙ্গ রাখালের কবিতা ও আমার বোধ

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

হাওয়াই ডাঙার ট্রেন

বঙ্গ রাখালের কবিতা ও আমার বোধ

  • প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারি, ২০১৯

কৃষক মাহমুদ

বাংলাদেশ যেমন নদীমাতৃক দেশ, তেমনি কবিমাতৃক দেশও বটে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এদেশের আলো-বাতাস হূদয়ে মেখে প্রত্যেক দশকেই জন্ম নেয় অজস্র কবি আর এদের মধ্য থেকেই কিছু কবি তাদের নিজস্ব স্বর বা ধারা সৃষ্টি করে প্রত্যেকের হূদয়ে টিকে থাকেন। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন- প্রত্যেকে কবি নয়, কেউ কেউ কবি। অজস্র কবির জন্ম হলেও কালের বিচারে টিকে থাকেন কয়েকজন মাত্র। তেমনি দ্বিতীয় দশকের কবি বঙ্গ রাখাল। যার কবিতায় রয়েছে আলাদা স্বর ও নিজস্বতা, যা আমাদের বারংবার ফিরিয়ে নিয়ে যায় মা, মাটির খুব কাছাকাছি, একান্ত গভীরে। তার কবিতা বলার ভঙ্গি অন্যদের থেকে আলাদা— একের মধ্যে বহুর সন্ধান। যাকে বলা হয় বহুস্বরের কবিতা।

বহুমাত্রিক সৃজনশীল লেখক ও কবি বঙ্গ রাখালের কবিতা পাঠ মানেই যেন এক আলাদা মেজাজের স্বাদ আস্বাদন করা যায়। কবির কবিতার মধ্যে বাউলিয়ানা উপমার ব্যবহার একটু বেশি যা গভীরভাবে উপলব্ধিতজাত। ভূমি, পৃথিবী, নারী কবির ‘হাওয়াই ডাঙার ট্রেন’ নামক কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেক কবিতার উপমার মূখ্য বিষয়। এসবের পরেও তিনি অনায়াসে কবিতায় এঁকে গেছেন নিজের কথা— বাংলার কৃষক, বাউল-ফকির, শহর-গ্রাম, শোষণ-নির্যাতন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অনিয়মতান্ত্রিকতা, মানুষের মানহীন জীবনযাপন ও রোহিঙ্গাদের ওপর অমানবিক নির্যাতনের কথাও উঠে এসেছে এ কাব্যগ্রন্থে। কবির চারপাশে ঘটে যাওয়া অতি সাধারণ বিষয়কেও তিনি উপকরণ বানিয়ে বুনে গেছেন কবিতার রসায়ন, যা কবির জীবনবোধ ও আত্মদর্শনকেই উপস্থাপন করে, “রাতে তোমার বুকে মাথা রেখে জ্বেলে দেবো আগুন”।

কবি বঙ্গ রাখালের কবিতায় এক ধরনের শূন্যতাবোধ, হতাশা, না পাওয়ার বেদনা কাজ করে আর সেসবকে আষ্টেপৃষ্ঠে অক্টোপাসের মতো জরিয়ে থাকে নারী আর যৌনতা। কবির অভিজ্ঞতা বহুমাত্রিক। তিনি ছোটবেলা থেকেই চষে বেড়িছেন গ্রাম হতে গ্রামে, শহর থেকে শহরে। কবি শহরের অলিগলিতে চলতে চলতে শিখে গেছেন কংক্রিটময় জীবন। এ জীবন বড় দুর্বিষহ। যেখানে ঠোঁট বাঁকিয়ে ‘বেশ ভালো আছি’ বলা ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না । কবি তার ‘জীবন’ নামক কবিতায় গল্পের ছলে মেদহীনভাবে বলে চলেছেন- নিজের কথা, বাড়ি, গোয়ালঘর, ঢেঁকিঘর, নিমতলা যা কবির ঘরগৃহস্থালির বিষয়াদি। অথচ এগুলোই কবিতার উপকরণ হয়ে কবিতাকে সুন্দর অবয়বে দাঁড় করিয়েছে— ‘আমাদের নিকোন উঠোন পার হলেই গোয়ালঘর, পাশে হেঁসেল।/যে হেঁসেলকে ভালোবেসে মা রাঁধুনী হতেন।’

কবি বঙ্গ রাখালের ব্যক্তি জীবনের মনুষ্যত্ব ও ব্যক্তি প্রতিভার সমন্বয় ও শূন্যতা কবিকে বার বার বিচলিত করে তোলে। কবির যে কষ্টগুলো কবিতায় উঠে উঠেছে সেটা ব্যতিক্রম কিছু না। যাপিত জীবনে সবার মধ্যেই কম-বেশি দেখা যায়। রোহিঙ্গাদের প্রতি যে চরম অমানবিক অন্যায়টা করা হয়েছে সেটা শহর বাস্তবতা, বেকারত্ব, ভিখারিদের দুর্বৃত্ত জীবনের কথা; এমনকি শহর ও শহরতলির পতিতার জীবন ও জীবিকার কথা উঠে এসেছে কবির ‘ছায়া’ কবিতায়, ‘বর্ষার জলে কখনো ভেজেনি আমার আয়েশী কোমল পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের শরীর।/সেই শরীর আজ পড়ে থাকে ধুলো মাটির জলে।’

কবি তার কবিতায় অনেক বিষয়াদি নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন এবং মানুষের ভাষাই যেন তার কবিতার মুখ্য ভাষ্য। কবির কবিতায় মানবিকতা যেভাবে মুদ্রিত তা সত্যিই আমাদের প্রেমিক করে তোলে। এছাড়াও তিনি ঐতিহ্য সচেতন কবিও বটে। তার কবিতায় তুলে ধরেছেন আদি পিতা অ্যামিবার কথা। কবি বলেছেন যে আমার যা কিছু পাওয়া— সবকিছু পিতা, পিতামহ ও প্রপিতা থেকে পাওয়া। কবি তার প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই একাধিক দিক এনেছেন। একটা কবিতায় শুধু একটা অর্থের অবতারণা না করে মিশিয়ে রেখেছেন একাধিক কাহিনি। এভাবে কবি অতি সহজ-সরল বাক্যে ব্যক্তি জীবনের টানাপড়েন, হা হা-কারকে জীবন্ত করে তুলেছেন প্রতিটি কবিতার পরতে পরতে। জীবনের  মলিনতা আর জীবনের ক্লেদ যেন কবিকে একজন সত্যিকার কবি হতে নানাভাবে সাহায্য করেছে। কবি বঙ্গ রাখাল নিজেকেই যেন ছাড়িয়ে যান কাল হতে কালান্তরে, এই কামনা। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads