শিরোনাম দেখে চোখ কপালে তুলছেন? সত্যিই বই চোর খুঁজছি। চারদিকে যখন দেখছি পুকুর চুরি আর সেই চোরের শানশওকত, শরীরভরা জেল্লাই চোখে পড়ছে, তখন মনে হয় বই চোরের খুব দরকার। নগদের আশায় পরিচয়হীন উড়ন্ত অর্থের পেছনে দিগ্বিদিকশূন্য দৌড়ঝাপ দেখে মন থেকে চাইছি বই চোরে দেশটা ভরে উঠুক।
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে পেশিশক্তি আর ব্যক্তির গৌরব দেখি সেটা তো এই বই চোরাদের অভাবেই। মেধা মননে যে একক শক্তি চেপে বসেছে সেও বই চোরাদের অভাবে। এই সংস্কৃতি এক যুগের নয়, ধারাবাহিক ভণ্ডামির ফল। অথচ বই চোরাদের উপদ্রব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে, এ-ই ছিল প্রত্যাশা। এই লক্ষ্যে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি- যা এখন ব্যক্তির পূজায় সংগঠনের পুস্তক ক্রয়, দেশব্যাপী বিপণন আর বছর শেষে নিজেদের সাফল্য দেখিয়ে বুলেটিন প্রকাশ করে। নিত্যনতুন প্রকাশনাও হচ্ছে, কিন্তু বই চোরাদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে আরো দ্রুতহারে।
ঘরে বিস্তর বই যেখানে লুকিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখতে হতো, সে বই এখন খোলাই থাকে। ছুঁয়েও দেখে না কেউ। মনে হয় বইয়ে ফরমালিন দেওয়া, ছুঁতে গেলেই অসুখ করবে। কিন্তু এ অসুখ যে হূদয়ের কাঠিন্য দূর করবে, মননশীল চর্চায় উদ্বুদ্ধ করবে- তা কে বোঝাবে? বড় দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের, সেখানেও এই ব্যাধি জেঁকে বসেছে। রাজনৈতিক কদাচারের চর্চায় যত সময় পার করেন মহামান্যরা তার সিকি ভাগও মনন চর্চায় ব্যয় করেন না। প্রতিপক্ষকে হেনস্থা করতে যত কূটকৌশল তার পেছনেই দিনের পুরো সময় পার করলেও হূদয়ের সুখানুভূতির জন্য, চারদিককে সুগন্ধিময় করতে একটু সময় পার করতে কোনো আয়োজন নেই।
শৈশবে মহল্লার মসজিদে মহামতি মাওলানা রুমীর মসনবী গ্রন্থটি চুরি করার অনেক চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হয়ে চকবাজার এমদাদিয়া লাইব্রেরি থেকে কিনতে হয়েছে। মহল্লার লাইব্রেরিতে উপন্যাস, গল্পগ্রন্থ, কবিতার বই, প্রবন্ধ, অনুবাদ গ্রন্থ, মনীষীদের জীবনী, অ্যাডভেঞ্চার গ্রন্থগুলো কিনেছি কিস্তিতে। সেটাও এসেছে সপ্তাহের বাজার থেকে চুরি করা অর্থে। আম্মা জানতে পেরে হেসেছিলেন। আমাদের স্কুল-বন্ধু বলতে গেলে সবারই কমবেশি বই আসক্তি ছিল। এই আসক্তি কখনো কখনো ইঁচড়েপাকামোকেও হার মানিয়েছে। সে সময় বহুবার বাৎসায়ন্যের কামসূত্র বইটির নাম শুনে সদ্য গোঁফ ওঠা চোখে যেন পূর্ণিমার আলোকেই ষোড়শী ভেবে স্বপ্নের ঘোরে ভেসেছি। বিছানার নিচ থেকে একটু একটু করে টাকা সরিয়ে সেটাও হস্তগত করলাম।
নিত্যনতুন বই পড়ার আগ্রহে বন্ধুর বাবার বইয়ের ভাণ্ডার থেকে লুঙ্গির মধ্যে গুঁজে সরিয়েছি কত বই তার হিসাব নেই। যেখানেই যেতাম ভালো লাগলেই বই চুরি করে আমার বইয়ের সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে উঠেপড়ে লাগতাম। তবে এটা একপক্ষের এমনটা নয়, অন্যরাও বহুবার আমার সঞ্চিত বই ভাণ্ডারে হাত গলিয়েছে, তখন কেঁদেছি। কলেজে পড়াকালীন দেখেছি লাইব্রেরিগুলোতে শিক্ষার্থীদের বই নিয়ে আলোচনা। তবে কদাচিৎ শরৎ, বঙ্কিমের বই নিয়ে আলোচনা হতো। এগুলোর অনেকাংশে প্রেমের বই ছিল তাই। যদিও চুরি করা দেবদাস পড়ে নিজেকে দেবদাস মনে হয়েছে। তারা শংকরের কবি পড়েছি বহুবার। কষ্ট পেয়েছি। কষ্টে প্রলেপ দিতে ফের পড়েছি। রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলো গিলেছি গোগ্রাসে। তেমনি মপাসাঁর গল্পসমগ্র। শেষমেশ বইটি নিজের কাছে রাখতে বন্ধুর সেলফ থেকে চুরি করতে হলো। তেমনি চুরি করেছি গ্রামবাংলা নিয়ে অধ্যাপক শাহেদ আলীর একমাত্র উপন্যাসটি। চুরি করার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি কবি জীবনানন্দের গল্পসমগ্র। অনুজ সাংবাদিক থেকে মেরে দিয়েছি সা’দত হাসান মন্টোর বিখ্যাত বই ‘গাঞ্জে ফারিস্তে’। জীর্ণ বইটি ১৫ টাকা দিয়ে অনুজপ্রতিম সাংবাদিক কিনেছিল পল্টন ফুটপাথ থেকে। অবশ্য ও নিজেও আমার বেশ ক’খানা বই মেরে দিয়েছে।
প্রয়াত অধ্যাপক প্রদীপ কুমার বিশ্বাসের অনেক দুষ্প্রাপ্য বই ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার এই সংগ্রহ গড়ে উঠেছিল। তাতে বেশকিছু বই চুরিরও ছিল। পরবর্তী সময়ে তার থেকে বেশকিছু বই মেরে দিয়েছেন দেশের প্রথিতযশা প্রাবন্ধিকরা। তাদের নাম অনুচ্চারিত থাক। বন্ধুবর বিবেশ রায় বহু মূল্যবান আর দুষ্প্রাপ্য বই চুরি করেছেন খ্যাতিমান সিনেমাটোগ্রাফার এম আবদুস সামাদের থেকে। আবার ওর থেকেও বই চুরি হয়েছে বেশুমার। যেমন ওর সংগ্রহশালা থেকে হরিপদ দত্ত, ইসমত চুগতাই, কৃষণ চন্দ, সোমেন চন্দর বইগুলো মেরে দিয়েছি।
বন্ধুবর প্রকাশক জামালের বদান্যতায় রাহুল সাংকৃত্যায়নকে জেনেছি। এর আগে অবশ্য মেরে দেওয়া ‘ভলগা থেকে গঙ্গা’য় তার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। খ্যাতিমান নারী আলোকচিত্রী সাঈদা খানম থেকে উপহার পাওয়া ‘স্মৃতির পথ বেয়ে’ বইটি শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নেতা কবি জাফর ওয়াজেদ দেওয়ার নাম করছেন না অনেক দিন।
মোবাইল-ট্যাবের এই যুগে রমরমা অবস্থা নেই নীলক্ষেত, পল্টন, সদরঘাটের পুরনো অভিজাত বইয়ের দোকানগুলোতে। সদরঘাটের ফুটপাথের দোকান উঠেছে একযুগ। যেখান থেকে দস্যু বনহুর, কাজী আনোয়ার হোসেনের বইগুলো কিনতাম। মনে পড়ে কয়েকজন করে যেতাম, এর মধ্য থেকে দু’একজনকে বলা থাকত চুরির কাজটা সেরে ফেলার জন্য। এখন আর সেই চুরি নিয়ে গ্লানি নেই, আছে গৌরব।
কিন্তু কী হলো হঠাৎ বই চোরের উৎপাত কমে গেল? এমন না যে চোরের উৎপাতে সদরঘাটের পুরনো বইয়ের দোকান উঠে গেছে। নীলক্ষেতের পুরনো দোকান উঠি উঠি করছে। তাদের ভাষ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির বই আর কেউ চুরি করে না। বহু আগে এদের উৎপাত ছিল।
অর্থনৈতিক সক্ষমতা যে হারে বেড়েছে ঠিক একই হারে কমেছে সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক বই পাঠের বিমুখতার হার। প্রকাশকরা দায়ী করছেন কারসাজি করে কাগজের দাম বাড়ানোকে। রম্যলেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘গাঁটের পয়সায় বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এমন কথায় আর পাঠকের মন ভরছে না। প্রকাশকরা বেশি দামে কাগজ কিনে কম মূল্যে বই বিক্রি করতে পারছেন না। সেখানে ব্যবসার ক্ষতি। মধ্যবিত্ত সমাজ বেশি দামে বই সংগ্রহ করতে পারছে না। তারপরও সাহিত্যের বদলে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় দলীয় বইগুলোর আওয়াজে ভালো বইগুলো থেকে যাচ্ছে আড়ালে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওগুলোতে চলছে এ ধরনের নোংরা অনুসরণের প্রতিযোগিতা। গত প্রায় দুই দশক ধরে চলছে এই পচন। পচনটা আজ গ্রাস করেছে বিবেককে। এখন মনে হচ্ছে বই চুরির ধারাবাহিকতা থাকলে বিবেক পচনের এই তামাশা দেখতে হতো না। এই পচনটা আমাকেও গ্রাস করেছে। অনীহা এসেছে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বই খুলতেও, লং-ড্রাইভে বইকে বোঝাই মনে হয়। এসব অস্বীকার করি কীভাবে?
বুকার পুরস্কারজয়ী লেখক হাওয়ার্ড বলেছেন, বইয়ের বদলে স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমাণে ফেসবুক, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস হ্রাস পাচ্ছে। এ কারণে প্রযুক্তির লাগাম টানার দরকার নেই। প্রয়োজন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক জায়গাগুলোর সদিচ্ছা। রাষ্ট্র চাইলে সাহিত্য-সংস্কৃতির বইগুলো থেকে শুল্কহার কমিয়ে প্রকাশকদের পাশে দাঁড়াতে পারে। তাহলেই বই চোরদের উৎপাত বাড়বে, দুর্নীতি, অমানবিক আত্মা সমাজকে কলুষিত করতে পারবে না।
আহমেদ তেপান্তর
গণমাধ্যমকর্মী