ফুটবলের এক জাদুকর ছিলেন সামাদ

ডাক টিকিটে ফুটবল জাদুকর সৈয়দ আব্দুস সামাদ

ছবি : সংরক্ষিত

ফিচার

ফুটবলের এক জাদুকর ছিলেন সামাদ

  • প্রকাশিত ২৫ জুন, ২০১৮

ইশতিয়াক অাবীর

সবাইকে মুগ্ধ করাই জাদুকরের কাজ। ফুটবলের ‘জাদুকর’ বলতে প্রথমেই আসে ম্যারাডোনা-পেলের নাম। মেসি কিংবা রোনালদোর মতো খেলোয়াড়দেরও জাদুকর তকমা দিয়ে থাকেন কেউ কেউ। কিন্তু আমাদের দেশেও যে ফুটবলের এক জাদুকর ছিলেন, সে কথা কি কেউ জানে? অনেক বছর আগে ব্রিটিশ শাসনামলে সেই জাদুকর এই ভূখণ্ডের ফুটবলকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। সৈয়দ আবদুস সামাদ ছিল তার নাম; জাদুকর সামাদ নামেই যার পরিচিতি।

সামাদের দুর্ভাগ্য, তার জন্ম হয়েছিল পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে অনগ্রসর এক ভূখণ্ডে। নয়তো, ফুটবল ইতিহাসের এক অনন্য নাম হিসেবে তাকেও স্মরণ করত পৃথিবীর মানুষ।

১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ-ভারতের বিহারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সামাদ। ছোটবেলা থেকেই তার ফুটবল প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটতে শুরু করে। পড়াশোনায় একেবারেই মনোযোগ ছিল না সামাদের। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনায় ইতি টানেন তিনি। এ সময়েই ফুটবল খেলায় পুরোপুরি মজে গিয়েছিলেন তিনি। মাঠের সঙ্গেই গড়ে তোলেন সখ্য।

ইতিহাস বলে তার গতি ছিল চিতার সমতুল্য। ড্রিবলিং ছিল মনোমুগ্ধকর। পূর্ণিয়ার জুনিয়র একাদশে শুরু জীবনের প্রারম্ভেই মাত করে দেন সবাইকে। খুব অল্প বয়সেই কলকাতার বড় বড় ক্লাবের কোচ-ম্যানেজাররা তার বাড়িতে লাইন ধরেছিলেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই তিনি ফুটবল খেলতে পাড়ি জমান সে সময়ের সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও খেলাধুলা চর্চার পীঠস্থান কলকাতায়।

১৯১৬ সালে ২১ বছর বয়সে তিনি মাঠে নামেন শক্তিশালী ইংলিশ ক্লাব সামারসেটের হয়ে। তিনি তার খেলায় মুগ্ধ করেন জাত্যাভিমানী ব্রিটিশদেরও। তার ক্যারিয়ারও দারুণ সমৃদ্ধ। ১৯২১ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত তিনি খেলেছেন বিখ্যাত ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের হয়ে। ১৯২৭ সালে তার দারুণ এক গোলেই ইংল্যান্ডের ম্যাশউড ফরেস্ট দলের বিপক্ষে জয় পেয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল।

সামাদ ভারতীয় জাতীয় দলের জার্সি গায়েও খেলেছেন। ১৯২৬ সালে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব। তিনি সে সময় ভারতের হয়ে বার্মা (মিয়ানমার), সিলোন (শ্রীলঙ্কা), সুমাত্রা-জাভা-বোর্নিও (ইন্দোনেশিয়া), মালয় (মালয়েশিয়া), সিঙ্গাপুর, হংকং, চীন ও ইংল্যান্ড সফর করেন। চীনের বিপক্ষে একটি ম্যাচে ভারত ৩-০ গোলে পিছিয়ে থাকার পরও তার দেওয়া চারটি গোলে ৪-৩ গোলে অবিস্মরণীয় এক জয় পেয়েছিল। তার খেলা দেখে ওই সময় স্কটিশ এক ফুটবলবোদ্ধা মন্তব্য করেছিলেন, ‘সামাদ ইউরোপে জন্মগ্রহণ করলে সে বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার হিসেবে স্বীকৃতি পেত।’ ওই সময় ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পড়ে কখনই পাদ-প্রদীপের আলোয় আসা হয়নি বাংলার ফুটবল জাদুকর সামাদের।

১৯৩৩ সালে ক্যারিয়ারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে কলকাতা মোহামেডানে যোগ দেন সামাদ। নিজের সেরা সময় পার করে আসার পরও মোহামেডানকে তিনি প্রায় একক কৃতিত্বে টানা পাঁচবার কলকাতা সিনিয়র ডিভিশন লিগে চ্যাম্পিয়ন করেন। এ সময় আইএফএ শিল্ডও ঘরে তুলেছিল মোহামেডান।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি স্থায়ীভাবে চলে আসেন পূর্ব বাংলায়। পার্বতীপুরে বাড়ি কিনে তিনি শুরু করেন ছিমছাম জীবন। তবে ফুটবলের আকর্ষণটা তিনি কখনই হারিয়ে ফেলেননি। যুক্ত হন সংগঠক হিসেবে। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বেতনভুক্ত ফুটবল কোচ হিসেবে চাকরি শুরু করেন। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সরকার তাকে সম্মানিত করে রাষ্ট্রপতি পদক দিয়ে। ১৯৬৪ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

জীবদ্দশায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি সামাদ। কিন্তু তিনি ছিলেন বাঙালি ফুটবলারদের আইকন। কালের পরিক্রমায় সামাদকে আমরা হয়তো সেভাবে মনে রাখিনি। কিন্তু তার কীর্তিগুলো সামনে নিয়ে এলে এই প্রজন্ম অন্তত তার স্মৃতি বুকে নিয়েই এগিয়ে যেতে পারত অনেকটা পথ।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads