প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদ বিপ্লবী বাঙালি নারী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

সংগৃহীত নারী

ফিচার

মহীয়সী নারী

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার

  • প্রকাশিত ১৯ অগাস্ট, ২০১৮

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে প্রথম শহীদ বিপ্লবী বাঙালি নারী। তিনি ৫ মে ১৯১১ সালে চট্টগ্রামের ধলঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভাদেবী। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতেই তার জন্ম। ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে প্রথম পড়াশোনার হাতে খড়ি। সালটা ছিল ১৯১৮। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলাফলের জন্য শিক্ষকদের প্রিয় ছিলেন তিনি। পড়াশোনায় মেধাবী প্রীতিলতা ১৯২৬ সালে সংস্কৃত পরীক্ষায় বৃত্তি পান এবং ১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরে ঢাকার ইডেন কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আইএ পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং মেধাতালিকায় পঞ্চম স্থান লাভ করেন। ভালো ফলাফলের জন্য মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পেয়ে কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশন নিয়ে বিএ পাস করেন। দর্শন বিষয়ে অনার্স করার ইচ্ছা ছিল তার; কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে অনার্স পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তার।

দেশমাতার মুক্তির জন্য মাস্টারদা সূর্যসেনের ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী দলে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তারই নির্দেশে তিনি চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ইউরোপীয় ক্লাবে দলবল নিয়ে আক্রমণ করতে যান। আক্রমণ ব্যর্থ হয়ে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে দেশের জন্য আত্মাহুতি দেন বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা।

ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণের সিদ্ধান্ত প্রথমবার নেওয়া হয়েছিল ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল। গুড ফ্রাইডের কারণে সেদিন আক্রমণ করা যায়নি। তারপর আক্রমণের চূড়ান্ত দিন ঠিক হয় ১৯৩২-এর ১০ আগস্ট। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে সাতজনের একটি দল সেদিন ক্লাব আক্রমণ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর প্রতিজ্ঞা ছিল ক্লাব আক্রমণের কাজ শেষ হওয়ার পর নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার সুযোগ থাকলেও তিনি আত্মবিসর্জন দেবেন। তিনি পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন। গভীর রাতে কাট্টলীর সমুদ্রসৈকতে তার মৃতদেহ সমাহিত করা হয়। মাস্টারদা এরপর ১৯৩২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ক্লাবে হামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। এই আক্রমণের দায়িত্ব তিনি নারী বিপ্লবীদের ওপর দেবেন বলে মনস্থির করেছিলেন। কিন্তু সাতদিন আগেই পুলিশের হাতে পুরুষবেশী কল্পনা দত্ত ধরা পড়ে গেলে আক্রমণে নেতৃত্বের ভার পড়ে একমাত্র নারী বিপ্লবী প্রীতিলতার ওপর। ২৩ সেপ্টেম্বর এ আক্রমণে প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোচা দেওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি, চুল ঢাকা দেওয়ার জন্য মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সোলের জুতা। ইউরোপীয় ক্লাবের পাশেই ছিল পাঞ্জাবিদের কোয়ার্টার। এর পাশ দিয়ে যেতে হবে বলেই প্রীতিলতাকে পাঞ্জাবি ছেলেদের মতো পোশাক পরানো হয়েছিল।

সেদিন ছিল শনিবার, প্রায় চল্লিশজন মানুষ তখন ক্লাবঘরে অবস্থান করছিল। ক্লাবের ভেতর থেকে রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিটে আক্রমণের নিশানা দেখানোর পরই ক্লাব আক্রমণ শুরু হয়। তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা ক্লাব আক্রমণ করে। পূর্বদিকের গেট দিয়ে ওয়েবলি রিভলভার এবং বোমা নিয়ে আক্রমণের দায়িত্বে ছিলেন প্রীতিলতা, শান্তি চক্রবর্তী আর কালীকিংকর দে। প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে কেঁপে উঠছিল। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাওয়ার কারণে সবাই অন্ধকারে ছোটাছুটি করতে লাগল। ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলভার ছিল। তারা পাল্টা আক্রমণ করল। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলভারের গুলিতে প্রীতিলতা আহত হন। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটির সঙ্গে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন।

পাহাড়তলী ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ শেষে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রীতিলতা পটাশিয়াম সায়ানাইড মুখে পুরে দেন। কালীকিংকর দে’র কাছে তিনি তার রিভলভারটা দিয়ে আরো পটাশিয়াম সায়ানাইড চাইলে কালীকিংকর তা প্রীতিলতার মুখের মধ্যে ঢেলে দেন। পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে। পরদিন ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে প্রীতিলতাকে শনাক্ত করে পুলিশ। তার মৃতদেহ তল্লাশির পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলভারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটি হুইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না; পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল তার মৃত্যুর কারণ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads