প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার মৌলভীবাজার

প্রতিনিধির পাঠানো ছবি

ফিচার

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার মৌলভীবাজার

  • মৌলভীবাজার প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৮

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাংশে অবস্থিত অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার মৌলভীবাজার জেলা। এ জেলার আয়তন ২ হাজার ৭৯৯ বর্গ কিলোমিটার। এর উত্তরে সিলেট জেলা, দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলা। মৌলভীবাজার জেলার মোট জনসংখ্যা ১৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬২ জন (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। এদের মধ্যে পুরুষ ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৭২৮ জন; মহিলা ৯ লাখ ৭৪ হাজার ৩৩৪ জন। জেলার পৌরসভার সংখ্যা ৫টি (মৌলভীবাজার, শ্রীঙ্গল, কুলাউড়া, বড়লেখা ও কমলগঞ্জ)। মৌলভীবাজার পৌরসভাকে বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর পৌরসভা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রশাসনের উদ্যোগে এই পৌরসভার ব্যাপক কর্মকাণ্ড চলছে। বর্তমানে পৌরসভাকে আরো আধুনিক ও মানসম্পন্ন নাগরিক সুবিধা দিতে কর্তৃপক্ষ ব্যাপক পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এই জেলা সাতটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো মৌলভীবাজার সদর, শ্রীমঙ্গল, রাজনগর, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা। জেলার প্রধান নদ-নদী ৬টি- মনু, বরাক, ধলাই, সোনাই, জুড়ী ও কুশিয়ারা

জেলার সীমান্ত ফাঁড়ির সংখ্যা ১৪টি (কুলাউড়ায় ৬, কমলগঞ্জে ৪, শ্রীঙ্গলে ২ ও বড়লেখায় ২)। ইউনিয়নের সংখ্যা ৬৭টি, গ্রামের সংখ্যা ২ হাজার ১৫টি। জেলার মোট চা বাগানের সংখ্যা ৯২টি। চা বাগানের মোট জমির পরিমাণ ১ লাখ ৬০ হাজার ২৬৪ দশমিক ৭৮ একর। জেলায় রবার বাগানের সংখ্যা ১০টি (রাজনগরে ২টি, কুলাউড়ায় ৪টি, কমলগঞ্জে ৩টি, শ্রীঙ্গলে ১টি)। রাবার বাগানের আয়তন ৬৬ হাজার ৩৫ দশমিক ৭ হেক্টর। এ জেলার শিক্ষার হার ৫১ দশমিক ১ শতাংশ (২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কলেজ ২৪টি (সরকারি কলেজ ৩টি, বেসরকারি কলেজ ২১টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ১৭৩টি (সরকারি ৩টি, বেসরকারি ১৭০টি)। মাদরাসা ৭১টি (দাখিল ৪৭টি, আলিম ১০টি, ফাজিল ১৩টি ও কামিল ১টি)। প্রাথমিক বিদ্যালয় ২ হাজার ৫৯৫টি (সরকারি ১ হাজার ৬টি, কিন্ডারগার্টেন ৩১৪, ইবতেদায়ি ১১৪টি, স্যাটেলাইট/কমিউনিটি/অন্যান্য ১ হাজার ১৬১টি)। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১টি, টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ১টি, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (পিটিআই) ১টি। জেলায় সরকারি হাসপাতাল রয়েছে মোট ৭টি।

প্রাচীন ইতিহাস অনুযায়ী, বহু আগে থেকেই মৌলভীবাজার তথা সিলেট অঞ্চল পবিত্র ভূমি হিসেবে পরিচিত। রামায়ণ ও মহাভারতের মতো উল্লেখযোগ্য মহাকাব্যে এ অঞ্চলের উল্লেখ রয়েছে। মৌলভীবাজার অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বাংশের কিছু অংশ ছাড়া বাকি সবটুকুই কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে।

সুলতানি আমলে বর্তমান সিলেট অঞ্চল বাংলার সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের (১৩০১-১৬২২) সময় মুসলমানদের অধিকারে আসে। আরবের ইয়েমেন থেকে আগত প্রখ্যাত দরবেশ হজরত শাহজালাল (র.)-এর সিলেট আগমনের পর তাঁর সঙ্গীসাথীদের মধ্যে অন্যতম হজরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র.) ইসলাম প্রচারের জন্য মৌলভীবাজারে অঞ্চলে আসেন। তিনি বাগদাদের অধিবাসী ছিলেন। মৌলভীবাজার শহরে তার মাজার রয়েছে।

১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা হারানোর পরই এদেশে ইংরেজ শাসন প্রবর্তিত হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করে এবং তালুকভিত্তিক জমিদার ও মিরাসদার শ্রেণি সৃষ্টি করে তাদের ওপর এদেশের মানুষের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের ভার অর্পণ করে। জমিদার, মিরাসদাররা অবিবেচকের মতো সাধারণ প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় শুরু করে। এর ফলে ইংরেজ কর্তৃক এ দেশবাসীকে শোষণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইংরেজদের শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে স্বাধীনতার প্রথম চেতনা প্রকাশে ঐতিহাসিক সিপাহি বিপ্লব সংঘটনে মৌলভীবাজার অঞ্চলের সিপাহিদের অবদান উল্লেখযোগ্য।

কথিত আছে, সৈয়দ শাহ‌ মোস্তফা (র.)-এর ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত ইয়াছিন (র.)-এর উত্তরপুরুষ মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ মনু নদীর তীরে ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে যে বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেই বাজারটি কালক্রমে প্রসিদ্ধিলাভ করে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বাজারটিকে কেন্দ্র করে ২৬টি পরগনা নিয়ে দক্ষিণ শ্রীহট্ট মহকুমা প্রতিষ্ঠা করা হয়। মৌলভী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ প্রতিষ্ঠিত এ বাজারে নৌ ও স্থলপথে প্রতিদিন লোকসমাগম বৃদ্ধি পেতে থাকে। ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগমের মাধ্যমে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে মৌলভীবাজারের খ্যাতি। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে দক্ষিণ শ্রীহট্ট বা সাউথ সিলেট নামের বদলে এ মহকুমার নাম মৌলভীবাজার রাখা হয়। ১৯৮৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার মহকুমা জেলায় উন্নীত হয়।

মৌলভীবাজার শহরের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ কুদরত উল্লাহ ১৭৫০ সালে মৌলভীবাজার জেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সৈয়দ হুরমত উল্লাহ। তিনি ১৭৯৩ সালে দেওয়ানি আদালতের মুন্সেফ নিযুক্ত হয়েছিলেন। মৌলভীবাজারের পশ্চিম বাজার তার প্রতিষ্ঠিত। তার কোনো ছেলেসন্তান ছিল না। তার দুই মেয়ে- সৈয়দা কারিজা বিবি ও সৈয়দা আরিজা বিবি।

মুক্তিযুদ্ধে মৌলভীবাজার ছিল ৪ নং সেক্টরের অধীন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন সি আর দত্ত। রাজনগর পাঁচগাঁওয়ের গণহত্যা, বড়লেখা ও কুলাউড়ার বধ্যভূমিতে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ আজো মানুষকে কাঁদায়। ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলা শত্রুমুক্ত হয়।

এ জেলার কীর্তিমান ব্যক্তিত্বরা হলেন হজরত শাহ মোস্তফা (র.), মৌলভী সৈয়দ কুদরতউল্লাহ, মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী হামিদুর রহমান, কবি মুজাফফর খান, সৈয়দ মুজতবা আলী, জাতীয় পরিষদ সিলেটের প্রথম মহিলা সদস্য বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী, সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসীন আলী, গবেষক ড. রঙ্গলাল সেন প্রমুখ।

এ জেলার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলো হচ্ছে রাজনগরের পাখিবাড়ি, পৃথিমপাশা নবাববাড়ি, কুলাউড়ার হাকালুকি হাওর, জুড়ীর কমলার বাগান, হজরত সৈয়দ শাহ মোস্তফা (র.)-এর মাজার শরিফ, মনু ব্যারেজ, চাঁদনীঘাট ইউপি গয়ঘরের ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ, বর্ষিজোড়ার ইকোপার্ক, মৌলভীবাজার সদরের কাগাবালা পাখিবাড়ি, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, আগর-আতর শিল্প, বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট, শ্রীঙ্গল টি রিসোর্ট, হাইল হাওর  মাধবপুর চা বাগান লেক, লাউয়াছড়া রিজার্ভ ফরেস্ট, বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমানের সমাধি ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত চা-কন্যা স্থাপত্য।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads