প্রকৃতিই আমার ক্লাসরুম

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

প্রকৃতিই আমার ক্লাসরুম

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ১৬ নভেম্বর, ২০১৯

আইভি জামান। বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পে অন্যতম নাম, একজন মননশীল ভাস্কর্যশিল্পী। ভাস্কর্য নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের কাছে আইভি জামানকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই। তিনি নিজেই নিজের পরিচয় বহন করেন তার কাজের মাধ্যমে। প্রখ্যাত ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের সহধর্মিণী হয়েও আইভি জামান নিজের কাজে আলাদা স্বকীয়তা তৈরি করে নিয়েছেন।

আইভি জামানের ভাস্কর্য নিয়ে সমালোচকরা বলেন, ‘কখনো কখনো তার কাজ গানের মতো, স্পষ্ট বোঝা যায়, কখনো বোঝা যায় না। আস্তে আস্তে, বারবার দেখতে গিয়ে, একটার পর একটা ইমেজ আলাদা মনে হয়। প্রতিটা ইমেজের আলাদা অর্থ আছে। চোখ বুজে তাকালে, রং ও রেখা আলাদা হয়ে ধরা দেয়, ঘূর্ণনের মতো। একটা ঘূর্ণন আর একটা ঘূর্ণন তৈরি করে। এসব ঘূর্ণন অনেকটা অ্যাবস্ট্রাকট, শব্দ দিয়ে বোঝানো সম্ভব না।’

‘সাতকাহন’-এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আইভি জামানের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার শিল্প ভাবনা, জীবনের নানাদিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-সালেহীন বাবু

আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা...

আইভি জামান : জন্ম বগুড়া শহরে ১৯৫৮ সালে। বাবা ডা. এমদাদুল হক তরফদার ছিলেন একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী। মা রওশনারা তরফদার গৃহিণী ও সমাজসেবী। পাঁচ বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে বগুড়া শহরেই। করতোয়া নদীর পাড় ঘেঁষে। তখন শহরটা ছিল শান্ত। লোকজনও ছিল কম। এত অট্টালিকা ছিল না। ধানক্ষেত, নীল আকাশ, ধানক্ষেতের মাঝ দিয়ে দূরে দিগন্ত। সব মিলিয়ে ছবির মতোন। এখনো আমি সেই ছবি খুঁজতে যাই ঠিকই, কিন্তু তা আর পাই না।

আপনার স্কুলজীবন এবং উচ্চতর শিক্ষা-

আইভি জামান : আমি ১৯৭৩ সালে বগুড়া সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হই। যেটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ। এখান থেকেই ১৯৭৯ সালে খ্যাতিমান ভাস্কর অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে ভাস্কর্যের বিষয়ে পাঁচ বছরের স্নাতক ডিগ্রি লাভ করি। এরপর ১৯৮৮-৮৯ সালে ভারতের শান্তিনিকেতনের কলাভবনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের প্রখাত অধ্যাপক সর্বরী রায় চৌধুরীর অধীনে ভাস্কর্যের ওপর ফরেন ক্যাচুয়াল ডিস্টিংশন কোর্স সম্পন্ন করি। এ ছাড়া ভাস্কর্য শিল্পের ওপর কোরিয়াসহ অন্য দেশে ওয়ার্কশপ করি।

এ পর্যন্ত আপনার ভাস্কর্য শিল্পের প্রদর্শনী-

আইভি জামান : দেশে ও বিদেশে এ পর্যন্ত আমি চল্লিশের অধিক গ্রুপ প্রদর্শনী করেছি। তিনটি একক প্রদর্শনী হয়েছে।

আপনার নির্মিত ভাস্কর্যগুলো কোথায় কোথায় স্থাপিত হয়েছে?

আইভি জামান : কোরিয়ার কিমচিয়ন সিটির জিক জি ভাস্কর্য পার্কে, ভারতের শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল, রংপুরের পায়রাবন্দে অবস্থিত বেগম রোকেয়া কমপ্লেক্স, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশসহ দেশ- বিদেশের অনেক স্থানে।

একজন ভাস্কর্যশিল্পী হওয়ার পেছনে উৎসাহের কারণ কি ছিল?

আইভি জামান : নিজের একান্ত ইচ্ছা এবং বাবার সহযোগিতা, সাপোর্ট, এরপর স্বামী এবং শিক্ষক খ্যাতিমান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের সহযোগিতা। আমি খুব ছোটবেলায় আমার চারপাশের পরিবেশ-প্রকৃতি থেকে আঁকতে শিখেছি। শিশু বয়সে স্কুলের গণিত খাতার পেছনে ছবি আঁকতাম। স্কুলে পড়ালেখা শেষে স্কুলে বসেই খাতার পেছনে ছবি আঁকতাম। এসব দেখে ম্যাডাম এক দিন আমায় বকা দিলেন এবং বাবাকে আসার জন্য বললেন। সেদিন তিনি বাবাকে বলেছিলেন, ‘আপনার মেয়ে তো সারাক্ষণ ছবি আঁকে, ওকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দিন।’ বাবা বিষয়টি খেয়াল করলেন। আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় জানতে পারলাম আর্ট নিয়ে পড়া যায়। তারপর পড়ার উদ্দেশে ঢাকায় আসা।

ভাস্কর্য শিল্পে এলেন কেন?

আইভি জামান : আমার পড়ার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার স্বামী এবং শিক্ষক হামিদুজ্জামান খানের বিশেষ সহযোগিতা ছিল। তিনি মনে করেছিলেন, আমি এ বিষয়ে ভালো করব। তবে আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল চিত্রশিল্প।

কোন বিষয়ের ওপর কাজ করে বেশি আনন্দ পান?

আইভি জামান : অবশ্যই ভাস্কর্য। কারণ এর প্রসেসটা আমার জানা আছে। আমি যে কাজটি করব মনে মনে তার একটা শেপ ঠিক করি। এরপর সেটা কাগজে ড্রয়িং করি। পরে তা কম্পিউটারে বড় করি। এরপর নির্ধারণ করি কাজটি আমি পাথর নাকি অন্য কোনো ধাতব পদার্থ দিয়ে করব।

ভাস্কর্য শিল্পে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থান-

আইভি জামান : আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে এ বিষয়ে পড়াশোনা করছে। তারা ভালোই করছে। আসলে কাজ করার জন্য জায়গা কম। আমি মনে করি, আমাদের পেইন্টারদের মতো অনেক বেশি কাজ করা উচিত। তাহলে ছেলেমেয়েরা বেশি কাজ করতে পারবে। বিশেষ করে মেয়েরা আরো কাজের সুযোগ পাবে।

আমাদের দেশে মহিলা ভাস্কর্যশিল্পীর সংখ্যা হাতেগোনা দু’একজন। এর পেছনে কি প্রতিবন্ধকতা কাজ করে বলে আপনি মনে করেন-

আইভি জামান : প্রথম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জায়গার অভাব। এরপর পারিবারিক সহযোগিতার অভাব। সংসার জীবনে স্বামী যদি একই বিষয়ের, মানসিকতার না হয় তাহলে সে, এ কাজ পছন্দ করবে না। যেমন আমি আমার কাজের প্রয়োজনে লোহার দোকানেও চলে যাই কিন্তু সব মেয়েরা হয়তো সেটা পারে না। এ জন্য সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও দায়ী।

আপনার শিল্পে কোন কোন বিষয় উঠে এসেছে?

আইভি জামান : আমি নারীদের ওপর অনেক কাজ করেছি। গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে, মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। মানুষকে বলা হয় জীবন্ত ভাস্কর্য। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন, আমি যখন একটি চুড়ি দেখি তখন তার মধ্যে ভাস্কর্য দেখি। ভাবি যদি এটাকে বড় করা যায় তাহলে কেমন হয়। কোনো জিনিসকে প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে যখন ভাবি এটা ভাস্কর্য হতে পারে তখন সেটা পিক করি। এবং এটার নান্দনিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করি। প্রকৃতিতেও অনেক ভাস্কর্য আছে। আমার ভাস্কর্যের অনেক বিষয়ই প্রকৃতি থেকে নেওয়া। প্রকৃতিই আমার ক্লাসরুম। যেমন- ক্লাসরুম ছিল চারুকলা আর শান্তিনিকেতন। আমি প্রকৃতি থেকে নেই, তবে হুবহু না। আমি প্রকৃতি থেকে এর নির্যাসটা নিয়ে আমার মতো করে একটা বলিষ্ঠ ফর্মের চিন্তা করি।

পেশাগত জীবনে আপনি একজন শিক্ষক, শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পের জন্য এতটা সময় কীভাবে পান?

আইভি জামান : আমি টিভি দেখি না। মার্কেটে যাই খুব কম। স্কুলে যখন অবসর থাকি তখন আমি ড্রয়িং করি। একটা বিষয় মাথায় এলো তার ছোট করে একটা ছবি আঁকলাম। এভাবে আঁকতে আঁকতে এক দিন খাতাটা ভরে যায়। সব ছবির মধ্যে অধিক পছন্দেরটা বাছাই করি। এক দিন হামিদুজ্জামানকে দেখাই কোনটা ভালো। এভাবেই চলে কাজের প্রক্রিয়া। আমার মনপ্রাণ কাজের মধ্যেই থাকে।

স্পেস ও ম্যাচের বিষয়টি আপনার শিল্পকর্মে কীভাবে উঠে এসেছে?

আইভি জামান : আমাদের চারপাশের যে শূন্য অবস্থান, সেই শূন্যের মধ্যে শেপ দিয়ে ওই জায়গাটিকে আমি দখল করি। তখন আমার ভালো লাগে। একজন পেইন্টার যেমন বৃষ্টির সময় প্রকৃতির একটা রূপ দেখে তেমনি আমি ফর্ম দেখি।

আপনি শিল্পে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের ব্যবহার করেছেন এর কারণ?

আইভি জামান : ভাস্কর্যটি যাতে ভঙ্গুর না হয়। এটাকে বলিষ্ঠ বোঝাতে, এর মধ্যকার শক্তিকে বোঝাতে ধাতব পদার্থের ব্যবহার করেছি।

খোদাইকৃত মানব অথবা প্রাণীর বাইরে আপনার শিল্পে বিষয়টি উঠে এসেছে ভিন্নভাবে-

আইভি জামান : আগে হুবহু ভাস্কর্য ছিল। এবং তা খুবই নিখুঁতভাবে করা হতো। আমরা এখন ওইরূপ থেকে বেরিয়ে এসেছি। আমি হুবহু করি না। আধুনিক ভাস্কর্যের গতির সঙ্গে এগোচ্ছি। আমার ভাস্কর্য লাইন প্লে করে।

আমাদের দেশে ভাস্কর্য শিল্পের বর্তমান প্রেক্ষাপট-

আইভি জামান : আমাদের দেশ ভাস্কর্যে অনেক এগিয়ে। আমি চাই, আরো একঝাঁক নতুন শিল্পী বেরিয়ে আসুক। প্রত্যেকে তার নিজস্ব চিন্তাধারায় ভাস্কর্য চর্চা করুক।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ভাস্কর্যশিল্পীর মূল্যায়ন হচ্ছে কি?

আইভি জামান : আগের চেয়ে এখন মূল্যায়ন হচ্ছে বেশি। তবে পেইন্টিংয়ের মতো অতটা না। আমরা আশাবাদী।

ভাস্কর্যশিল্পী হয়ে উঠতে কোনো প্রতিবন্ধকতা...

আইভি জামান : নিজের ভেতরে যদি আত্মবিশ্বাস থাকে, সেক্ষেত্রে কোনো বাধাই বাধা না। যদি কাজ করার ইচ্ছা থাকে আর উদ্দেশ্য সৎ হয় তাহলে করা সম্ভব। কাজ যদি আমি করি তবে বাধা দেওয়ার কেউ নেই।

শৈল্পিক জগতে উঠে আসার ক্ষেত্রে একজন নারী কি পুরুষের সমমর্যাদা পাচ্ছে?

আইভি জামান : অবশ্যই। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের বাধা মনে করি, নারী ভেবে পিছিয়ে থাকি তাহলে আমাদের থেমে থাকার কারণ আমরাই হব। আমি মনে করি, আমি একজন মানুষ। পুরুষরা যেটা পারে আমিও তা পারি।

ভাস্কর্য শিল্পে বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান?

আইভি জামান : সব অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বড় বড় বিল্ডিংয়ের সামনে ভাস্কর্য থাকবে। সরকারি প্ল্যানিং এ ভাস্কর্যের জন্য জায়গা থাকবে। আমি পূর্ণ ভাস্কর্য উদ্যান দেখতে চাই। যে উদ্যানে আমাদের সব ভাস্কররা কাজ করবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads