রেজাউল করিম হীরা:
নানামুখী উদ্যোগেও থামছে না শ্রমিক অসন্তোষ। বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে শ্রমিকদের। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতি এড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পোশাক কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
শিল্প মালিকরা বলছেন, দেশের তৈরি পোশাক শিল্প অস্থিতিশীল করে তুলতে দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় নানা অজুহাতে আন্দোলন ও কারখানা ভাঙচুর করতে শুরু করে দুর্বৃত্তরা। এভাবে চলতে থাকলে, ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখে পড়বে পোশাক খাত। ফায়দা নিতে ওতপেতে আছে বেশ কিছু দেশ।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমার মনে হয় আন্দোলনকারীরা শ্রমিক না। তারা বিভিন্ন কায়দায় অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে। এর পেছনে কাদের ইন্ধন সেটি বোঝা কঠিন কোনো কাজ না।
বিকেএমইএ পরিচালক মো. মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, পোশাক শিল্পে অস্থিরতার পেছনে বহিরাগত শক্তির সঙ্গে দেশি-বিদেশি চক্রের যোগসাজশ থাকতে পারে।
গত রোববার রাজধানীর গুলশানস্থ পুলিশ প্লাজায় মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এমসিসিআই) এক সভার আয়োজন করে।
সভায় সংগঠনের মহাসচিব ফারুক আহমেদ বলেন, গত এক মাসে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নানা দাবি নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এতে শতাধিক শিল্প-কারখানায় ভাঙচুর করা হয়। একই সঙ্গে আগুন দেওয়া হয়।
এ সময়ে দুই শতাধিক কারখানার উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। আপাতত ধারণা করা হচ্ছে, শিল্পের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, তবে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।
তিনি বলেন, কারখানায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই সরকার শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। আর পদক্ষেপ নিলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তৈরি পোশাক শিল্পে সরাসরি প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। আর পরোক্ষভাবে উপকারভোগী কমপক্ষে দুই কোটি মানুষ। এ শিল্প বিপদে পড়লে বিশাল জনগোষ্ঠী বিপদে পড়বে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি।
শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে গত কয়েক দিন নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। কারখানার মালিক, শ্রমিক নেতা ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়েও হয় সমন্বয় সভা। পোশাক কারখানাগুলোতে নেওয়া হয়েছিল ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর পরও শ্রমিক অসন্তোষ থামানো যাচ্ছে না।
বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা গতকাল সকালে কাজে যোগ না দিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এ অবস্থায় গাজীপুর, সাভার ও আশুলিয়ার ৯০টি কারখানায় বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে মালিক কর্তৃপক্ষ।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, অন্যায্য আন্দোলনের সঙ্গে জড়িতরা শ্রমিক নয়। কারা আন্দোলন করছে, তাদের খুঁজে বের করা দরকার। মালিকপক্ষ বলছে, যৌথ বাহিনী বারবার আশ্বস দিলেও পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি না হওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা রয়েছে।
জানতে চাইলে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, নির্ধারিত সময়ে শ্রমিকরা কারখানায় উপস্থিত হলেও তাদের দাবি আদায় না হওয়ায় কাজ বন্ধ করে বসে থাকেন। ফলে কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধের নোটিশ টাঙিয়ে দেয়। সোমবার বেশ কিছু এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ায় ৯০টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হয়।
তিনি আরও বলেন, রোববার কয়েকটি পোশাক কারখানায় হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট হয়েছে।
বাংলাদেশ অ্যাপারেলস ওয়ার্কার্স ফেডারেশন সভাপতি তৌহিদুর রহমান বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে ১৫ বছরে পোশাক খাতে মজুরি ইস্যু ছাড়া অন্য কোনো ইস্যুতে আন্দোলন হয়নি। এখন মজুরির বাইরে নানা ইস্যু নিয়ে আন্দোলন প্রমাণ করে, এর পেছনে ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। আবার কোনো কোনো কারখানায় কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। তার মতে, গত সাড়ে ১৫ বছর একপক্ষ কারখানা থেকে ঝুট, কাটপিস, স্টকলটসহ নানা দিক থেকে সুবিধা ভোগ করেছে। এখন নতুন পক্ষ তৈরি হয়েছে। দুই পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বেও শ্রমিকদের ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব চলছে শ্রমিক আন্দোলনের নামে।
গাজীপুর টঙ্গীতে ঠিক সময়ে বেতন ও ১৩ দফা দাবি নিয়ে একটি কারখানার শ্রমিকরা বিক্ষোভ করছেন। গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেডের দুটি কারখানার প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কারখানার সামনে বিক্ষোভ করছেন।
গতকাল সকাল ৮টা থেকে টঙ্গী পূর্ব থানার পেছনে কেবিএম রোডের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করছেন শ্রমিকরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে এসে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদের বুঝানোর চেষ্টা করছেন।
শ্রমিকরা জানান, গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ভিলেজ লিমিটেডে দুটি কারখানা আছে। একটি মা টাওয়ারে আরেকটি আলম টাওয়ারে। এই দুই কারখানায় প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কিন্তু আমরা আমাদের ন্যায্য কোনো কিছুই পাচ্ছি না। আমরা ১৩ দফা দাবি জানিয়েছি। না হলে কাজে ফিরব না।
চার বছর আগে বন্ধ হওয়া লেনী ফ্যাশন ও লেনী অ্যাপারেলস তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবিতে গতকাল সকালে ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের (ডিইপিজেড) মূল ফটকের ভেতরের অংশে মানববন্ধন করেন। এ ছাড়া ধামরাই উপজেলার ইসলামপুর এলাকায় জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাটা গ্রিন ফ্যাক্টরির সামনে কাজ বন্ধ রেখে বিক্ষোভ করেন আরম্যাক সার্ভিসেস লিমিটেডের কর্মচারীরা।
মানববন্ধনে শ্রমিক মো. আজাদ বলেন, ‘২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লেনী ফ্যাশন ও লেনী অ্যাপারেলস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সময় কারখানা দুটির শ্রমিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেপজার পক্ষ থেকে যে কোনো একটি কারখানা বিক্রি করতে পারলে বিক্রির সেই টাকা দিয়ে সবার বকেয়া পরিশোধের আশ^াস দেওয়া হয়েছিল। ৬ মাস আগে একটি কারখানা ৮৩ কোটি টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমাদের পাওনা ৬৬ কোটি টাকা। বিক্রির টাকা ব্যাংকে জমা থাকলেও আমাদের দেওয়া হচ্ছে না। বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান চাই।’
আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ ও তৈরি পোশাক কারখানা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সোমবার সকালে নির্ধারিত সময়ে সাভার ও ধামরাই উপজেলার বিভিন্ন তৈরি পোশাক কারখানায় উপস্থিত হন শ্রমিকরা। তবে আশুলিয়ার জামগড়া, নরসিংহপুর, ইউনিকসহ আশপাশের কয়েকটি এলাকায় কারখানার শ্রমিকরা বেতন, হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধসহ নানা দাবিতে কারখানায় কাজে যোগ না দিয়ে কারখানা থেকে বের হয়ে যান। পরিস্থিতি বিবেচনা করে ওই সব কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া শ্রমিকদের দাবি পূরণ করতে না পারায় আগে থেকেই অনেক কারখানার ফটকে কারখানা বন্ধ ও ছুটির নোটিশ টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
এদিন সকাল ৮টার দিকে ধামরাই উপজেলার ইসলামপুর এলাকায় জুতা প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাটা শু ফ্যাক্টরির মূল ফটকের সামনে আরম্যাক সার্ভিসেস লিমিটেডের কর্মচারীরা বেতনবৈষম্য দূর করা, স্থায়ী শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি, স্থায়ী শ্রমিকদের ক্যানটিন ভাতা, আন্দোলনকারী শ্রমিকদের ছাঁটাই না করাসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন। পরে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলে শ্রমিকরা শান্ত হন।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে আবদুল্লাহপুর থেকে বাইপাইল পর্যন্ত সড়কের শিমুলতলা এলাকায় হাজিরা বোনাস, গত মাসের বেতনসহ নানা দাবিতে ইউফোরিয়া অ্যাপারেলস লিমিটেড নামের একটি কারখানার শ্রমিকরা সড়ক অবরোধের চেষ্টা করেন। তখন সেনাবাহিনী ও শিল্প পুলিশের সদস্যরা তাদের সড়ক থেকে সরিয়ে দেন।
গত রোববার রাতেও হাজিরা বোনাস, টিফিন বিল বৃদ্ধি, গত মাসের বেতনসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন এই তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। বিক্ষোভের সময় কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া র্যাব ও সেনাবাহিনীর দুটি গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করেন বিক্ষোভকারীরা।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৪, সিপিসি-২-এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর জালিস মাহমুদ খান বলেন, দুষ্কৃতকারীরা র্যাবের একটি গাড়ি ভাঙচুর করে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে। পরে তারা আগুন নিভিয়ে ফেলেন। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর একটি গাড়িতেও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। বিষয়টি ছায়া তদন্ত চলছে। শিল্পাঞ্চলে যারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টা করছে, সেসব দুষ্কৃতকারীকে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।
গতকাল আশুলিয়ার বিভিন্ন সড়কে টহল দিতে দেখা গেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা। এ ছাড়া বিভিন্ন কারখানার সামনে মোতায়েন রয়েছেন সেনাবাহিনী, শিল্প পুলিশ ও এপিবিএনের সদস্যরা।





