অপুষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ দারিদ্র্য। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, সরকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানাভাবে সহায়তা অব্যাহত রাখলেও গত দশ বছরে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে সাত লাখ। কারো কারো মতে, সংখ্যাটি আরো বেশি। সংখ্যা কম-বেশি যাই হোক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে অপুষ্টিজনিত সমস্যা ক্রমান্বয়েই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ সুস্থ ও সবল দেহ নিয়ে বেড়ে ওঠার অন্যতম নিয়ামক খাদ্যের অভাবে পুষ্টিহীনতা দেশের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুষ্টির অভাবজনিত কারণে জনস্বাস্থ্য সমস্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন স্বাধীনতা-উত্তর কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও সবার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখনো সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর দেশের সাত কোটি মানুষের খাদ্য সঙ্কট ছিল প্রবল। এর মূল কারণই ছিল অপ্রতুল খাদ্য উৎপাদন। চাহিদার সিংহ ভাগ চাল ও গমের বাজার ছিল আমদানিনির্ভর। ফলে মানুষকে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাতে হতো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর অসহযোগিতা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দুর্বল অর্থনীতি ইত্যাদি কারণে ’৭৪-এর দুর্ভিক্ষের মোকাবেলা করতে হয়েছিল বাংলাদেশকে। নিদারুণ সেই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। একমাত্র সেচভিত্তিক উচ্চ ফলনশীল বোরো চাষের বদৌলতে ধীরে ধীরে মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণ হতে থাকে। মূলত এ দেশের কৃষকের নিরন্তর প্রচেষ্টায় সাত কোটি জনসংখ্যার স্থলে আজ ষোলো কোটি মানুষের খাদ্য চাহিদার সিংহভাগই দেশীয়ভাবে পূরণ হচ্ছে।
অথচ জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে বসতবাড়ি। মানুষের প্রয়োজনে রাস্তাঘাট, হাটবাজার, অফিস-আদালত, নগরায়ণের কারণে চাষযোগ্য জমির আয়তন অনেক কমেছে এবং কমেই চলেছে। কিন্তু মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। এখনো বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানি বন্ধ হয়নি। সরকারি বেসরকারিভাবে চাল, গম আমদানি এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে আমরা এটুকু নিশ্চিত করে বলতে পারি, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার যে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে তা যদি ধরে রাখা যায়, তাহলে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে। শঙ্কার জায়গাটি হচ্ছে, নীতিগতভাবেই আমাদের মধ্যেই যেন আমদানি নির্ভরতার প্রবণতা কাজ করে থাকে। দেশ ধান-চালের উৎপাদনে যত দূর সফলতা অর্জন করেছে, তুলনামূলক গম চাষে তেমন অগ্রগতি সাধিত হয়নি। অথচ বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশে বছরে গমের চাহিদা প্রায় ৪০-৪৫ লাখ টন। দেশে গম উৎপাদন হয় মাত্র ১৪-১৫ লাখ টন। বাকি গম বিদেশ থেকে প্রতিবছর আমদানি করতে হয়। যথাযথ কর্মপরিকল্পনার অভাবে গমের চাষ সম্প্রসারণ হচ্ছে না। অথচ গম চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ ক্রমান্বয়েই বাড়ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে খরা প্রবণতা, দেশের নদ-নদীগুলোর নাব্য হ্রাস পাওয়ায় চরাঞ্চলের পরিসীমা বেড়েছে। আর চরের দোআঁশ মাটিতে স্বল্প সেচে গম উৎপাদনের যখন যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তখন সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে- এ দেশে গমের ভালো উৎপাদন হয় না। এমতাবস্থায় যেসব শীতপ্রধান দেশে গমের উৎপাদন হয়, সেসব দেশ থেকে এটি আমদানি করাই সুবিধাজনক বিবেচনা করা হচ্ছে। এই পর্যবেক্ষণ কোনোভাবেই সঠিক নয়, বরং ভ্রান্ত নীতিমালা। এই শস্যটির উৎপাদন ও সংরক্ষণে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গত কয়েক বছরে গমের উৎপাদন কমে এসেছে। দেশে যে ১৪-১৫ লাখ টন গম উৎপাদন হয়, ভুলনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আগামীতে এই পরিমাণ গমও উৎপাদন হবে না। সরকারিভাবে যে এক দেড় লাখ টন গম অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করা হতো, তাও এখন বন্ধ।
অথচ দোআঁশ মাটিতে গম, ভুট্টা, আলুর চাষ খুবই ভালো হয়। তেমন একটা সেচও দিতে হয় না। অন্যদিকে আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। প্রতিনিয়তই পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। সব বিবেচনায় আত্মঘাতী এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে গম উৎপাদনের দিকে নজর বাড়াতে হবে এবং উৎপাদিত গম অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করতে হবে। তাহলে চাহিদার সিংহভাগ গম দেশীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হবে। কৃষিই আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। সেই কৃষির উন্নয়নে নজর না দিয়ে আমদানিনির্ভরতা বাড়ানোর কারণেই এক সময়ের জমিনির্ভর মধ্যবিত্ত শ্রেণি জমি হারিয়ে প্রান্তিক চাষি কিংবা বর্গাচাষি হয়েছে। আর নিম্নবিত্ত কৃষক পরিবারগুলো জমি, বসতভিটা হারিয়ে ঠাঁই নিয়েছে নগর-মহানগরের বস্তিগুলোতে। এখন চাষের জমি কৃষকের বদলে বিত্তশালীদের দখলে চলে গেছে। আর যেটুকু জমি কৃষকের হাতে রয়েছে তাতে তারাও এখন চাষাবাদ করে লোকসান গুনতে গুনতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারছেন না। স্মরণে রাখতে হবে, উৎপাদন সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে কৃষি ও কৃষকবান্ধব পরিকল্পনা থাকা জরুরি। কারণ কৃষকের উৎপাদিত ধান ও গমের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হলে সরকারকে অভ্যন্তরীণভাবে তা সংগ্রহ করতে হবে। তা না হলে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না।
বাস্তব এ অবস্থার কারণেই কৃষক পরিবারগুলো দরিদ্র থেকে আরো দরিদ্র হচ্ছে। ফলে খাদ্য সঙ্কটের মুখে অপুষ্টিজনিত মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। যদিও সরকার পুষ্টির ঘাটতি পূরণে ইতোমধ্যেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন সহায়ক প্রকল্প ও পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল বিতরণ শুরু করেছে। যদিও এসব প্রকল্পে সুবিধাভোগী পরিবারের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। শুধু পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল সরবরাহ করলেই হবে না, বাস্তবে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যত দিন মানুষ নিজে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার কিনে খেতে পারবে না, তত দিন পুষ্টির অভাব পূরণ করা কঠিন হবে। বাস্তব এ অবস্থাকে বিবেচনায় নিয়ে সরকার পুষ্টি খাতের উন্নয়নে ২০১১ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি ৫৭ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সে প্রকল্পেও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এএফও) ইউনিসেফ, ডব্লিউএফপি, ডব্লিউএইচও যৌথভাবে বিভিন্ন দেশের পুষ্টি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। সংস্থাগুলোর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অপুষ্টির শিকার মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার পান না। ৫৫ লাখ শিশু অপুষ্টির শিকার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের সিটি করপোরেশন ও বিভাগীয় শহরের বস্তিগুলোয় পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪০ শতাংশ শিশু পুষ্টির অভাবে খর্বকায়। কারণ মা যদি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেতে না পারেন, তাহলে সন্তান খর্বকায় হবে- এটাই স্বাভাবিক। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেকই নারী। সেই নারীদের ৬০ শতাংশ যদি অপুষ্টিতে ভোগে, তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অপুষ্টি নিয়েই জন্মগ্রহণ করবে। মোটকথা, পুষ্টিজনিত সমস্যা দূরীকরণে দরিদ্রতার হারকে কমিয়ে আনা ব্যতীত অন্য কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সমাজদর্শী