জেলা শহরের অদূরে স্বনির্ভর এলাকায় গতকাল শনিবার সকালে অস্ত্রধারীদের ব্রাশফায়ারে সাতজন নিহত ও চারজন আহত হয়েছে। নিহতদের বেশিরভাগই ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) প্রসীত খিসা গ্রুপের সমর্থক। প্রাথমিকভাবে প্রশাসন ধারণা করছে, পাহাড়ি সংগঠনগুলোর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে। অপরদিকে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-এমএন লারমা) দাবি করেছে, এই হতাহতের জন্য দায়ী ইউপিডিএফের দুই পক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দল।
গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে পৌনে ৯টার মধ্যে ঘটা ওই হামলার পর থেকে এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, এ দিন সকালে গ্রামবাসীদের নিয়ে প্রসীত খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের সমাবেশ ও বিক্ষোভ করার কথা ছিল। লোকজন জড়ো হওয়ার মুহূর্তেই স্বনির্ভর বাজার ও আশপাশের এলাকায় আকস্মিকভাবে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় অস্ত্রধারী দুর্বৃত্তরা। এ সময় স্বনির্ভর বাজারে অবস্থিত পুলিশ বক্সেও গুলি লাগে।
গুলিতে নিহতদের মধ্যে অধিকাংশই ইউপিডিএফ সমর্থক নেতাকর্মী বলে জানা গেছে। নিহতদের মধ্যে তপন চাকমা (২৩), এলটন চাকমা (২৮), বরুণ চাকমা (২৬), জিতায়ন চাকমার (৫২) ও স্বর্ণময় চাকমার (৭০) নাম জানা গেছে। এদের মধ্যে তপন চাকমা ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের খাগড়াছড়ি জেলার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। জিতায়ন চাকমা মহালছড়ি উপজেলা সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক বলে জানা গেছে। আহতদের মধ্যে তিনজনকে প্রাথমিক চিকিৎসার পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছেন খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তারা হলেন- সমর বিকাশ চাকমা (৪৮), সুকিরন চাকমা (৩৫) ও সোহেল চাকমা (২২)।
পুলিশ জানিয়েছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। আধিপত্য বিস্তার নাকি অন্য কোনো কারণে এই হামলা হয়েছে সেটা তদন্তের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন খাগড়াছড়ি সদর থানার পুলিশ সুপার আলী আহমদ।
খাগড়াছড়ি সদর থানার ওসি শাহাদাত হোসেন জানান, ইউপিডিএফের প্রসীত গ্রুপের লোকজন সকালে একটি সমাবেশ ও মিছিল উপলক্ষে জড়ো হচ্ছিল। এ সময় অস্ত্রধারীরা পাশের একটি পুলিশ বক্স, সিএনজি স্ট্যান্ড এবং ইউপিডিএফের কার্যালয়ের সামনে জটলা লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ শুরু করে। যা চলে প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে। এতে ইউপিডিএফের সদস্যসহ সাধারণ পথচারী হতাহত হয়। বেলা ১১টার দিকে পরিস্থিতি পুলিশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে বলেও জানান তিনি।
খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. নয়নময় ত্রিপুরা বলেন, পাঁচজনকে নিহত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছিল। আহত অবস্থায় আনা হয়েছিল চারজনকে, তাদের মধ্যে একজন হাসপাতালে মারা যায়। জানা গেছে, আরো দুজনকে আহতাবস্থায় পাওয়া যায়। এদের মধ্যে হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান স্বর্ণময়।
এ ঘটনার পর স্থানীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্রলাল ত্রিপুরা, জেলা প্রশাসক শহিদুল ইসলাম, পুলিশ সুপার আলী আহমদ খান হাসপাতালে গিয়ে হতাহতদের খোঁজখবর নেন। স্বনির্ভর বাজার এলাকার বাসিন্দা ও ইউপিডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সদস্য অমল বিকাশ ত্রিপুরা বলেন, ‘আমরা আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় আছি। ঘর থেকে বের হতে পারছি না।’
এদিকে প্রসীত বিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের জেলা সমন্বয়কারী মাইকেল চাকমা এ হামলার জন্য জেএসএসকে (এমএন লারমা) দায়ী করেছে। অবশ্য জেএসএসের পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সংগঠনটির দাবি, ইউপিডিএফের দুই পক্ষের মধ্যকার অন্তঃকোন্দলের ফলেই এ ঘটনা ঘটেছে।
পার্বত্য শান্তিচুক্তিবিরোধী প্রসীত বিকাশ খিসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফের প্রভাব বেশি খাগড়াছড়িতে। তবে দলটিতে ভাঙনের পর দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত লেগে আছে। এ বছরের ৩ জানুয়ারি খাগড়াছড়িতে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় ইউপিডিএফের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা মিঠুন চাকমাকে। এই হত্যার জন্য ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিককে দায়ী করেছিল ইউপিডিএফ। এরপর ১৭ ফেব্রুয়ারি জেলা শহরের হরিনাথপাড়া এলাকায় ইউপিডিএফকর্মী দীলিপ কুমার চাকমাকে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। তার চার দিন পর দীঘিনালায় সুভাষ চাকমা নামের আরেক ইউপিডিএফকর্মী খুন হয়।
গত ১৬ এপ্রিল শহরের পেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসী হামলায় সূর্য বিকাশ চাকমা নামে একজন নিহত হয়। সেও ইউপিডিএফের দুই অংশের বিরোধের কারণে মারা গেছে বলে ধারণা করা হয়। এরপর গত ৪ মে খাগড়াছড়ি থেকে রাঙামাটি যাওয়ার পথে খুন হয় ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের অন্যতম শীর্ষ নেতা তপন জ্যোতি চাকমা বর্মাসহ পাঁচজন।