পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুরোদমে চলছে কাজ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র

সংরক্ষিত ছবি

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

নিরাপত্তায় সর্বাধিক গুরুত্ব

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে পুরোদমে চলছে কাজ

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

সুপার স্ট্রাকচারের কংক্রিট ঢালাই, ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং অবকাঠামো নির্মাণসহ গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকারে থাকা কাজসমূহ পুরোদমে এগিয়ে চলছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ। বৃহৎ এই প্রকল্পের কাজে নিরাপত্তার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, আর্থিক সহায়তা ও সরাসরি তত্ত্বাবধানে পাবনার রূপপুরে এ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজ চলছে। তাদের রাষ্ট্রীয় সংস্থা আণবিক শক্তি করপোরেশন ‘রোসাটম’-এর অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এএসই গ্রুপ অব কোম্পানিজ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দুই ইউনিট বিশিষ্ট এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ হবে ২০২৩ সালে এবং দ্বিতীয় ইউনিটের কাজ শেষ হবে ২০২৪ সালে।

সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পের মূল ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ চলছে। একই সঙ্গে রিঅ্যাক্টর, টারবাইন ও গুরুত্বপূর্ণ ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের কাজও শুরু হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের ফাউন্ডেশনের কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। শুরু হয়েছে সুপার স্ট্রাকচারের কংক্রিট ঢালাইয়ের কাজ। এখন পর্যন্ত প্রকল্পটির ২৭ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা আরো জানান, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর দুটির প্রতিটিতে ১৫টি নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। এর মধ্যে ৭টি অ্যাকটিভ অর্থাৎ বিদ্যুৎ দ্বারা চালিত এবং ৮টি প্যাসিভ অর্থাৎ বিদ্যুৎ ছাড়া চালিত। নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলের নিচে থাকছে প্রায় ৭৫০ টন ওজনের একটি মোল্টেন কোর ক্যাচার।

ইতোমধ্যে মোল্টেন কোর ক্যাচার স্থাপন করা হয়েছে। কোনো কারণে তাপমাত্রা অতিরিক্তি বৃদ্ধির কারণে রিঅ্যাক্টরের কোর (ভেতরের অংশ) গলে গেলে এই মোল্টেন কোর ক্যাচারটি উচ্চ তাপমাত্রা সম্পন্ন গলিত তেজস্ক্রিয় পদার্থ ধারণ করে তা শীতল করবে। এর ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ কোনো অবস্থাতেই রিঅ্যাক্টর বিল্ডিংয়ের বাইরে আসতে পারবে না। মোল্টেন কোর ক্যাচার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি। এর আগে শুধু রাশিয়ার নভোভরেনেজ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে এটি ব্যবহার করা হয়েছে।

এ ছাড়া নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর পেসার ভেসেলের ভেতর পারমাণবিক বিক্রিয়ার ফলে ইউরেনিয়াম জ্বালানির যেসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ উৎপন্ন হবে তা যেন কোনো অবস্থাতেই পরিবেশে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের রিঅ্যাক্টরে পাঁচ স্তরবিশিষ্ট বিশেষ নিরাপত্তা বেষ্টনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর প্রথম নিরাপত্তা বেষ্টনী হচ্ছে ফুয়েল প্যালেট বা জ্বালানির গঠন। রিঅ্যাক্টরে ব্যবহূত জ্বালানি ইউরেনিয়াম ডাই-অক্সাইড। এর গঠন অনেকটা সিরামিকের মতো। এ ধরনের গঠনের ফলে তেজস্ক্রিয় পদার্থ সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। দ্বিতীয় বেষ্টনীটি পারমাণবিক জ্বালানির চারপাশে ঘিরে থাকা জিরকোনিয়াম ধাতু দ্বারা তৈরি আবরণ। আর তৃতীয় স্তরে রয়েছে ২০ সেন্টিমিটার পুরু ইস্পাত দিয়ে তৈরি প্রেসার ভেসেল।

চতুর্থ ও পঞ্চম নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করবে প্রথম ও দ্বিতীয় কনটেইনমেন্ট বিল্ডিং। প্রথম কনটেইনমেন্ট বিল্ডিংয়ে ১.২০ মিটার পুরু বিশেষ কংক্রিটের দেয়াল এবং দ্বিতীয় কনটেইনমেন্ট বিল্ডিংয়ে ০.৫০ মিটার পুরু বিশেষ কংক্রিটের দেয়াল রয়েছে। এটি এমনভাবে তৈরি করা হবে যা ঘণ্টায় প্রায় ৪৫০ মাইল বেগে ধাবমান ৫.৭ টন ওজনের একটি বিমান এটির ওপর আছড়ে পড়লেও কনটেইনমেন্টের কোনো ক্ষতি হবে না। এ ছাড়া এটি রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প ও ঘণ্টায় প্রায় ১২৫ মাইল গতিবেগের টর্নেডো সহনীয়।

এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনায় দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এটমস্ট্রয় এক্সপোর্টের সঙ্গে চুক্তির আওতায় প্রায় দেড় হাজার প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন শ্রেণির লোকজনসহ মোট তিন হাজার জনবলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রশিক্ষণ কার্যক্রমও ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। মস্কো ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিকস ইনস্টিটিউটে (মেফি) নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয়েছে। শিক্ষার্থীদের প্রথম ব্যাচ উচ্চশিক্ষা শেষে গত বছর দেশে ফিরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে যোগ দিয়েছেন।

এ উচ্চশিক্ষা কার্যক্রমে প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের নেওয়া হচ্ছে এবং এটি ২০২২ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া ভারতের পরমাণু শক্তি সংস্থার সহযোগিতায় ইতোমধ্যে ১৪৩ জন শিক্ষানবিস কর্মকর্তা ভারতে ফাউন্ডেশন কোর্স অন নিউক্লিয়ার এনার্জি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

এই প্রকল্পে নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ব্যবহার করা হবে। এই জ্বালানি সরবরাহে রাশিয়ান নিউক্লিয়ার ফুয়েল সাপ্লাই কোম্পানির (টিভিইল) সঙ্গে প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে।

ইউরেনিয়াম-২৩৫ জ্বালানি সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা জানান, এক গ্রাম ইউরেনিয়ামে প্রায় ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রায় ৩ টন কয়লা প্রয়োজন হয়। গত বছর জুলাই পর্যন্ত এক গ্রাম ইউরেনিয়ামের আন্তর্জাতিক বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৬.৩০ ইউএস সেন্ট যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫.৩০ টাকা। একই সময় ৩ টন কয়লার দাম ছিল ১৯৫ ইউএস ডলার বা ১৬ হাজার টাকা।

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে প্রকল্পের ২৭ ভাগের মতো কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অবকাঠামা নির্মাণকাজ থেকে শুরু করে ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিংসহ সব ধরনের কাজ এগিয়ে চলছে প্রত্যাশা অনুযায়ী। আমরা আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে পারব।’

এদিকে এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বাংলাদেশ উন্নতির এক নতুন সোপানে প্রবেশ করবে। নতুন চেহারায় উদ্ভাসিত হবে সুখী-সমৃদ্ধ আমাদের বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads